১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। আমার স্ত্রী কৈরবী একদিন একটা কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এতে বাবার লেখা তিরিশটা কবিতা আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কবিতার বই বার করতে হবে।” আমি জানতে চাইলাম, “কোথায় পাওয়া গেল?” আমার প্রশ্নে কৈরবীর উত্তর, “সাড়ে তিন বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পরে বাবার বই ও কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। এতদিন মা-র কাছে ছিল। মা আজ সকালে আমাকে দিলেন।”
প্যাকেট খুলে দেখি, লিগ্যাল সাইজের কাগজে টাইপ করা ইংরেজি কবিতা। প্রথম পাতায় কবিতার বইয়ের নাম: থার্টি পিসেস অফ লুনাসি। তলায় কবির নাম: দিলীপ কুমার অধিকারী।
কবিতার বই প্রকাশের ব্যাপার হলেও, আমার কাছে ওটা শ্বশুরবাড়ির কাজ। তাই অবিলম্বে কাজে নেমে পড়তে হল।
কাজে হাত দিয়ে দেখি, কবিতাগুলির নাম নেই, যতি চিহ্নের ঠিকঠিকানা কিছু নেই, এমনকি কবিতার স্তবক বিভাজনও নেই! বুঝলাম, টাইপিস্টের কাঁচা কাজ দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে শ্বশুরমশাই ওতে বানান সংশোধন ও এখানে ওখানে দু-একটা শব্দ পরিবর্তন করা ছাড়া আর কিছু করেননি। মনে মনে ভাবলাম, সমস্যায় পড়া গেল! যতি চিহ্ন বসিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও, কবির দেওয়া যতিচিহ্ণের সঙ্গে তা হুবহু মিলবে না। নাম নেই যখন, তখন সংখ্যা দিয়ে কবিতাগুলিকে চিহ্নিত করা ছাড়া উপায় নেই। আর স্তবক বিভাজন আদৌ সহজ কাজ নয়। ফলে যত তাড়াতাড়ি ভাবা গিয়েছিল, তত তাড়াতাড়ি কবিতার বই বার করার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হল।
কৈরবী ও আমার মাস দেড়েকের চেষ্টায় কবিতার স্তবক বিভাজন হল ও কবিতাগুলিতে যতিচিহ্ণ বসানো হল। তিরিশটা কবিতা থেকে সাতটা কবিতা বাদ পড়ল। ওই সাতটা কবিতার রাজনৈতিক ও দার্শনিক বক্তব্য যা তাতে মনে হল, কবি ছাড়া অন্য কারো ওগুলো প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। ফলে, কবিতার সংখ্যা কমে দাঁড়াল তেইশ। সেই কারণে, কৈরবীর পরামর্শে কবিতার বইয়ের নতুন নামকরণ হল: মাই লুনাসি। গৌতমদা (শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়) তখন কলকাতার নন্দন ফিল্ম লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। তাঁর সহায়তায় একদিন কবিতার বই বেরিয়ে গেল। ‘মাই লুনাসি’-র প্রকাশ কাল আটই মে, ঊনিশ শো বিরানব্বই। কবি মারা গিয়েছিলেন ঊনিশ শো অষ্টআশি সালের মে মাসের দশ তারিখ।
‘মাই লুনাসি’-র কবিতাগুলি পড়তে পড়তে মনে হল, ‘সব চেয়ে দুর্গম যে মানুষ….!’ গুরুগম্ভীর যে মানুষটাকে দেখেছি এতদিন, তাঁর মধ্যে তলে তলে এতসব ছিল! জীবনের আপাত তুচ্ছ বিষয় তাঁর কলমের নিপুণ আঁচড়ে এক একটা নিটোল কবিতা হয়ে গেছে। শব্দচয়ন, ছন্দযোজনা, পরিমিতিবোধ ও নন্দনচেতনা দেখে চমকে উঠলাম! কবিতাগুলিতে ব্যবহৃত কোনো শব্দের পরিবর্তে অন্য কোনও শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শব্দের পারম্পর্য হয়তো বদলানো যায়, কিন্তু তাতে ভাষার সৌকর্য ও নান্দনিকতা ব্যাহত হবেই। লাইনের মাপ, লাইন সাজানো, পূর্ববর্তী লাইনের সঙ্গে পরের লাইনের ছন্দ ও ধ্বনিগত পরিপূরকতা কবিতার ভাব ও রসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলে গেছে। কবির ছোটবেলার স্কুলের স্মৃতি নিয়ে লেখা কবিতাটা দেখা যাক।
My first school was meant for girls There I had to sew a hanky The elder girls had their cooking class They cooked food tasty. I used to weep I did not like to go to school The girls pulled my leg And called me a fool. Boys-- we were only two And were great pals He used to tell me tales And I was ready to listen always. One day there was an accident The blackboard which stood on a stool Fell on my head. The girls at once brought some dishes They had cooked that day Which made me again jolly and gay. We fought sometimes The girls with their nails We with our blows The fight ended With broken bangles And scratched nose!
নিঃসন্দেহে, একটা খুব ভালো কবিতা। কবিতাটা পড়তে পড়তে আমরা আমাদের ছোটবেলার স্কুলে চলে যাই।
পরের কবিতাটা তাঁর তিন মেয়েকে নিয়ে। তিন স্তবকের ছোট একটা কবিতা, যা যে কোনও পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
There is my daughter Only one year old Pulling my clothes Weeping and uttering words Unintelligible. There is the other Mother calling her Yet she is playing with her dolls Unmindful. And yet another the first one At her school Poor girl longing for her home Pale and tearful.
ওই ‘Only one year old’ থেকে হিসেব করে বলে দেওয়া যায়, কবিতাটা ১৯৭০ সালে লেখা। কবির বয়স তখন বিয়াল্লিশ বছর। তখন তিনি পুরুলিয়া জেলার ঝালদায় কর্মরত। ‘And yet another the first one’ মানে কৈরবী তখন হোস্টেল-এ থেকে রাঁচির বিশপ ওয়েস্টকট গার্লস স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। সত্যিকারের ভালো কবিতায়, ব্যক্তি বিশেষের কথাও সবার কথা হয়ে ওঠে। এটি তেমনই একটি কবিতা।
জীবনের কোনোকিছুই সরলরেখায় চলে না। সর্বশক্তিমান প্রকৃতি যে দ্বান্দ্বিক নিয়মে চলে, মানবমন তাকেই অনুসরণ করে। আমাদের নিত্যদিনের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে আমাদের কথায় ও কাজে। চৈতন্য ও বোধের অধিকারী বলে আমরা সমঝে চলতে চাই। কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে আমাদের মুখ থেকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়েই। তখনই তেতে ওঠে আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত। মুখভার, কথাবন্ধ! শেষে আপস করে শান্তি। পরের কবিতায় কবির তেমনই এক অভিজ্ঞতার শরিক হব আমরা।
This time it was about her sister My wife said 'Look she is now a research scholar of the university.' I said, 'How could she?' I uttered some uncharitable words About her sister And few unprintables about the selectors This infuriated her. Next morning she refused to serve me breakfast It was her answer to my blast I was feeling hungry I thought it wise To compromise. At last I got my tea But before that I had to agree That her sister was a prodigy Of a rare degree.
‘This time’ থেকে বুঝতে পারি, এটাই প্রথমবার নয়। হয়তো শেষবারও নয়। কখনো এটা, কখনো ওটা নিয়ে আমাদের জীবনভর এরকম চলতেই থাকে!
এবার আমরা কবির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে যাব। ইদানিং পরিবেশ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে, হচ্ছে অনেক সভা ও সেমিনার। পরিবেশপ্রেমীরা সবুজ বাঁচাতে নানা রকম আন্দোলন গড়ে তুলছেন। দেশেবিদেশের পাঠক্রমে পরিবেশবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান নামে পরিবেশ নিয়ে নানারকম কোর্স পড়ানো হচ্ছে। নীচের কবিতাটায় আমরা দেখব, প্রকৃতিপ্রেমী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে, কবি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে পরিবেশ রক্ষার কথাই বলেছেন। বলেছেন টিম্বার মার্চেন্টদের নির্মম বৃক্ষনিধনের কথা, মুনাফার জন্য এদের লোভ ও লালসার কথা।
Oh! the creator of Opu-- Why left you so early leaving us To the merchants of vice and crime, so unscrupulous and unholy? Don't you see from heaven How they have turned The garden you tended so dearly Into a dumping ground of putrid garbage and filth so ugly? Like an eagle you soared so high In the sky Above all petty things of life. You have seen things from a lofter height, Never cared for the carcasses on which vultures fix their sight. You gave us nectar They give us poison You gave heaven's bliss They offer hell's filth and fire. Oh! Bibhutibhushan! I wish Today you were here.
বিভূতিভূষণ থাকলে বৃক্ষনিধন আটকানো যেত– কবির এই মনোভাব অপুর স্রষ্টার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার প্রতিফলন। আমরা জানি, বৃক্ষনিধনকারী মুনাফাবাজদের কাছে অমর কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানাকড়ি মূল্যও নেই।
এবার আমরা ‘মাই লুনাসি’-র মানুষটির মুখোমুখি হব। তাঁর কথা শুনতে শুনতে তাঁর কবিতায় চোখ রাখব আবার।
১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকার সামান্য দূরে নারায়ণগঞ্জে তাঁর জন্ম। বাবার নাম নৃত্যগোপাল অধিকারী ও মায়ের নাম নন্দরাণী অধিকারী। পাঠশালার পড়া শেষ করে তিনি নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে ভর্তি হন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৩ সালে এই স্কুল থেকে বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া অন্য সব বিষয়ে লেটার পেয়ে মেট্রিক পাশ করেন। এই স্কুল নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। এই স্কুল থেকেই তাঁর বাবা মেট্রিক পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন। কথায় কথায় এই স্কুলের বহু উজ্জ্বল ছাত্রের নাম বলতেন যাঁরা পরবর্তী কালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বলতেন আই সি এস করুণাকেতন সেনের কথা, যিনি এই স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। এই স্কুলের স্মৃতি নিয়েও একটা কবিতা আছে তাঁর, যা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
I imagine That I am roaming Invisible In the school where I spent seven years of my existence very fruitful. I remember with fond affection The first year The teacher who taught us English was always jovial and feverish with excitement and joy The whole class used to go hilarious when he danced, jumped and acted like a boy. In that story-- Alladin and his lamp The giant he used to be we, Little children Small Alladins all Got from him not what Alladin got, This giant gave us Not jewels, palaces and princesses But profound joy, laughter and blissfulness.
স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন। ইচ্ছে ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ভূগোলে অনার্স পড়ার। তাঁর বাবা ছিলেন বেঙ্গল হেল্থ্ সার্ভিসের ডাক্তার। তিনি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দেন। এতে স্বাভাবিক গতি হারিয়ে তাঁর জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করে।
ডাক্তারি পড়ায় মন ছিল না তাঁর। মন পড়ে থাকত ভূগোলের বইয়ে ও মানচিত্রে। এদিকে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আলাপ হল সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসুর সঙ্গে। শিশিরকুমার বসুও তখন মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ছেন। ”মহানিষ্ক্রমণ’-এর পরে সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানি ঘুরে জাপানে গিয়ে নেতাজী পরিচয়ে ভারতবাসীর কাছে তখন অসম্ভব জনপ্রিয়। অবিভক্ত বাংলায় সুভাষ উন্মাদনার জোয়ার বইছে তখন। এই পরিস্থিতিতে নেতাজীর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য পুলিশের খাতায় নাম উঠল। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় মেডিক্যাল কলেজে নাম কাটা গেল তাঁর। সেই বয়সে ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য,/ চিত্ত ভাবনাহীন।’ সুতরাং কোনও কিছু নিয়েই তখন ভাবার সময় নেই।
১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুসংবাদ ভারতবাসী সেদিন বিশ্বাস করেনি, বাঙালি তো করেইনি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশাভঙ্গ শুরু হয়ে যায়। নেতাজীর অভাবে অনেকে হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ‘মাই লুনাসি’-র কবি বোধ হয় একটু বেশিই হতাশ হলেন। বাবার জন্য ভূগোল পড়া হয়নি, রাজনীতির জন্য ডাক্তারি পড়া শেষ হয়নি। ততদিনে তাঁর বাবা রাজনৈতিক ডামাডোলের আবহে বদলি হয়ে এপার বাংলায় চলে এসেছেন। অনেকগুলি মূল্যবান বছর চলে যাওয়ার পরে, নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রটি পাশ কোর্সে স্নাতক হলেন। স্নাতক হয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসে যোগ দিলেন গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৮৬ সালে তিনি মালদার ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন।
সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করার সময় তিনি অনেক গরিব মানুষের জমি গ্রামের ধান্দাবাজদের কবলে যাওয়া থেকে আটকেছিলেন। আজ থেকে ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে গ্রামের দিকে জোর করে কিংবা মদ ও মাংস খাইয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অনেকের জমি লিখিয়ে নেওয়া হত। এরকম কেস এলে উনি কোনো না কোনো অছিলায় জমির রেজিস্ট্রেশন আটকে দিয়ে গরিব চাষীর গ্রামে গোপনে খবর পাঠাতেন। চাকরির গোড়ার দিকে উনি হুগলির পাণ্ডুয়াতে কর্মরত ছিলেন। উনি মারা যাওয়ার পরে, পাণ্ডুয়ার এম এল এ দেবনারায়ণ চক্রবর্তী (এখন প্রয়াত) বলেছিলেন, “দিলীপবাবুর সঙ্গে আমার খুব সুন্দর বোঝাপড়া ছিল। ওনার কাছে গিয়ে খবর নিতাম কোনও গরিবের জমি ঠকিয়ে কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে কিনা। অনেক সময় উনি নিজে থেকেই খবর দিতেন। সব ক্ষেত্রে না পারলেও, এই খবর লেনদেনের ফলে বেশ কিছু গরিব মানুষের জমির হাতবদল আটকাতে পেরেছিলাম। দুঃখের বিষয়, উনি পাণ্ডুয়া থেকে বদলি হওয়ার পরে, এই সুবিধে আর কারো কাছে পাইনি।”
চাকরির বাইরে তাঁর সময় কাটত মূলত বই পড়ে। অনেক রকম বই পড়তেন। তবে ইতিহাস ও সাহিত্যের বই-ই বেশি পড়তেন। তাঁর বই পড়া নিয়ে ‘মাই লুনাসি’-র ভূমিকায় কৈরবীর মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যায়। “Father was great lover of books, a voracious reader and endowed with a good intellect.”
আর ছিল রেডিও শোনার নেশা। যাবতীয় বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি খবর মন দিয়ে শুনতেন। প্রত্যেকদিন আনন্দবাজার পত্রিকা ও দি স্টেটসম্যান আগাগোড়া খুঁটিয়ে পড়তেন। হিন্দি ও ইংরেজি প্রায় মাতৃভাষার মতো জানতেন। গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালির তুলনায় তাঁর সংস্কৃত উচ্চারণ ছিল অনেক শুদ্ধ ও সংস্কৃত।
বাঙালিদের মধ্যে কিছু মানুষ ছিলেন যাঁদের নেতাজী ছাড়া গীত ছিল না। এঁরও নেতাজীপ্রীতি প্রায় অবসেশন-এর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ‘নেতাজী নেই বলেই দেশের এই দুর্দশা, নেতাজী থাকলে এটা হত না, এমনটা হত না’– ইত্যাদি কথা প্রায়শই বলতেন। এই ‘এটা হত না, এমনটা হত না’-র মধ্যে জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি থেকে ছোটখাটো চুরি-জোচ্চুরি সবই থাকত।
ডাক্তার শিশিরকুমার বসুর সঙ্গে যোগাযোগ কোনোদিন ছিন্ন করেননি। কলকাতায় এলে এলগিন রোডে শিশিরকুমার বসুর কাছে যাওয়া তাঁর বরাবরের কর্মসূচির মধ্যে থাকত। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে এলগিন রোডে যাওয়া বেড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় ও শিশিরকুমার বসু কংগ্রেস ছেড়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস দল গঠন করলে তিনি সেই দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ নিয়ে তিনি অনেক কথাই বলতেন। সব শুনে মনে হত তাঁরা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। একদিন তাঁদের ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে কথায় কথায় ওই প্রসঙ্গ উঠতে তিনি বলেছিলেন “না না, জীবিকার জন্য নারায়ণগঞ্জে যাওয়া। আমরা আদতে বাঁকুড়ার লোক। ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় আমাদের জ্ঞাতি। ওনাকে দেখিনি, তবে ওনার ছেলে অশোককাকার স্নেহ পেয়েছি। ‘অধিকারী’ আমাদের উপাধি, এখন এটাই পদবি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বংশগত পদবি চাপা পড়ে গেছে।’ এই পর্যন্ত বলে বসার ঘর থেকে ভেতরের দিকে একবার তাকালেন। তারপর গলা একটু নামিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তবে তোমার শাশুড়িরা পুব বাংলার। স্বাধীনতার আগে থেকে কলকাতায় বাড়ি থাকলেও, ওঁদের আদি বাড়ি কুমিল্লায়। ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথি আন্দোলনের জনক দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য তোমার শাশুড়ির দাদু (তোমার শাশুড়ির বাবার জ্যাঠামশাই)।’ উনি থামতে আমি তাঁকে বলেছিলাম, “তার মানে, আপনারা স্মরণীয় মানুষের উত্তরসূরি।” তার উত্তরে উনি যা বলেছিলেন তা মনে রাখার মতো। বলেছিলেন, ‘গোটা বাঙালি জাতিই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও মহেশ ভট্টাচার্যের উত্তরসূরি। এতে আমার বা তোমার শাশুড়ির আলাদা কোনও অংশিদারিত্ব নেই। আসল ব্যাপার হল, হোয়াট উই আর। আমি নিজে নেতাজী না পেঁয়াজি হয়েছি, সেটাই বড়ো কথা!”
চাকরিসূত্রে ঝালদায় থাকার সময় ঝালদার নিসর্গ তাঁকে অভিভূত করেছিল। তিনি গাছ ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন অরণ্য, সমুদ্র, পর্বত। ঝালদায় থাকার সময়, বিহারের নেতারহাট থেকে অনেকগুলি ইউক্যালিপটাস, শিশু ও পাইন চারা এনে তাঁর অফিস ও সরকারী কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠে রোপন করে সযত্নে তাদের বড়ো করেছিলেন। এই গাছেদের নিয়ে লেখা তাঁর একটা কবিতা এখানে উদ্ধৃত করা যায়।
When I see my handiwork Standing high and erect Their heads nodding While I pass by them My heart leaps with joy. When I see one of them Crushed, chewed or uprooted My heart bleeds. For are they not mine and of me? Have I not bestowed on them My love, affection and care? For years and years to come Will they not speak of me And my abiding love for them? Take that pine Brought when a mere sapling From distant hills By the lady of my love What care, what abiding care She bestowed on it Gods of this earth and Heaven Have witnessed how every morning She and I Sprinkled life giving water on it How we counted every new leaf Every new branch That sprouted out of it. And now it stands Taller than a man Evergreen and full of life And those Eucalypta Their heads reaching Heaven So young yet so high and so magnificent Standing and living monuments Of my labour of love For ever proclaiming That here lived a man Who did not rob nature Of her bounties But instead gave her back What others have mercilessly plundered.
ঝালদার সৌন্দর্যে তিনি মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। এবার ঝালদা নিয়ে লেখা তাঁর একটা কবিতা তুলে ধরব।
When rains come in Jhalda With all their majesty and fury It is sight for gods to see. By my window Planted only two years ago Stands the Eucalyptus Like Perseus Tall, strong and handsome. But a single shower Makes it quiver All its strength gone Pitiable and forlorn. Yonder is Bansa In a sunlit day The hill looks so lofty and awesome When the rains come All its fury is gone Behind thick dark clouds Its heads it shrouds. And near by Sikra Hill With its body velvety green Stands behind my home Clean and tidy Like a well-groomed dandy But then a smart shower And all its brightness disappears Instead a drab and colourless Sikra Looks so poor, sundown and cadaverous
ঝালদার ভূপ্রকৃতি, বন-জঙ্গল, পাহাড়, বিশাল বিশাল বাঁধ (জলাশয়) প্রভৃতি নিয়ে এতই মেতে উঠেছিলেন যে, ঝালদার পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে ১৯৭০ সালে একটা পুস্তিকা লিখে বিলি করেছিলেন। পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ দেবেন্দ্রনাথ মাহাতকে দিয়ে তিনি ঝালদার বিষয়টা লোকসভায় তুলিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, ঝালদা নিয়ে তাঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময় একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঝালদা বেড়াতে গেলে ‘মাই লুনাসি’-র কবি তাঁকে দু-দিন ধরে অনবরত ঝালদার পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে বুঝিয়েছিলেন। তাঁকে ঝালদার আনাচে-কানাচে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন ঝালদার নৈসর্গিক রূপ ও সৌন্দর্য। তাঁকে দিয়েছিলেন ঝালদা নিয়ে তাঁর লেখা পূর্বোল্লেখিত পুস্তিকা। এসব কিছুরই উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি ঝালদা নিয়ে বড়ো করে লেখেন। তাঁর এবম্বিধ প্রযত্নের ফলশ্রুতিতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঝালদা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় সবিস্তারে লিখেছিলেন।
ঝালদাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার কথা তাঁর প্রিয় শহর জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৭২ সালে লেখা পুস্তিকাটাতেও উল্লেখ করেছেন। ওই পুস্তিকা থেকে ঝালদার অংশটুকু নীচে তুলে দিচ্ছি।
…….”আমি বর্তমানে চাকুরী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমতম প্রান্তে পুরুলিয়া জিলার ঝালদাতে বসবাস করি। গত দু বছর ‘ঝালদা’কে একটি ট্যুরিস্টকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলবার প্রয়াসে আমি অনেকদূর অগ্রসর হয়েছি। দু বছর আগে প্রথমে একটি পুস্তিকার মাধ্যমে আমি পশ্চাদপদ এই পুরুলিয়া জেলার ‘ঝালদা’র প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং বলি পশ্চিমবাংলার দার্জিলিং জেলা বাদে এই রূপ পাহাড় ও জঙ্গলের সমন্বয় আর কোথাও নেই। আমার এই লেখার ও আমার প্রয়াসের উচ্চ প্রশংসাসমণ্বিত এক বিস্তারিত আলোচনা যার বিষয়বস্তু ছিল ‘ঝালদা’ গত ১৪/১৫-১১-১৯৭০ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখক ছিলেন শ্রী শক্তি চট্টোপাধ্যায়। গত ১১-১২-১৯৭০ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সাপ্তাহিক ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এ আমার লেখার এক সারাংশ ছাপা হয়। এছাড়া গত ২০-০৬-১৯৭১ তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় আমার লিখিত একটি পত্রও প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তু ছিল ট্যুরিস্টকেন্দ্র হিসাবে ‘ঝালদা’র উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আমার এই চেষ্টার ফলে আজ দলে দলে ভ্রমণকারী ঝালদার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন।”
নারায়ণগঞ্জ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে লেখা তাঁর পুস্তিকাটাও পাঠিয়েছিলেন। শিশুর সারল্যে তিনি বিশ্বাস করতেন, কথার মধ্যে যুক্তি থাকলে এবং সেই কথা ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারলে, তা ক্ষমতাসীন মানুষদের কর্ণগোচর হবেই।
গুরুগম্ভীর ও রাশভারি প্রকৃতির মানুষটি ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর কণ্ঠস্বরও ছিল তদনুরূপ। চশমার আড়ালে থাকা অত্যুজ্জ্বল দুটো চোখ থেকে বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হত। প্রয়োজন ছাড়া লোকজনের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতেন না। বই, খবরের কাগজ ও রেডিওর বাইরে তাঁর আর কোনও বিনোদন ছিল না।
তবে এসবই ছিল তাঁর বাইরের দিক। একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যেত, তাঁর ভেতরে ফল্গুধারার মতো অন্তর্লীন ছিল মানুষের জন্য অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা।
নিজেকে তিনি একজন ব্যর্থ মানুষ মনে করতেন। তাঁর নিজের ভাষায় ‘A good for nothing fellow.’ স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর যে অ্যাকাডেমিক স্বপ্ন দেখেছিলেন, ডাক্তারি পড়ার সময় নেতাজীর নেতৃত্বে যে ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার পরে প্রাণধারণের জন্য চাকরি ও সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব যন্ত্রের মতো পালন করে গেছেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই সত্যিকারের আনন্দ পাননি। দৈনন্দিন প্রাণধারণের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে একেক সময় একেক রকম স্বপ্নের আশ্রয় নিয়েছেন। ঝালদার পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে মেতে থাকা, নারায়ণগঞ্জ নিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে চিঠি লেখা, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে আবার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া, সবই তাঁর এক একটা স্বপ্নদ্যোগ। যখন বাইরের এরকম কোনও উদ্যোগ, উত্তেজনা থাকত না, তখন একান্তে কবিতার স্বপ্ন দেখতেন। ‘মাই লুনাসি’ তাঁর এরকমই স্বপ্নের ফসল।
When the years roll by My poetry goes staler And the poet vanishes in the atmosphere Would you care My good reader To go through the torn pages Of the book of verse Published many, many years ago Long before your birth. Please do not get angry If he fails to kindle in your heart The same passion, the same feelings That moved the poet Please do not despise him If he proves a failure A good for nothing fellow. In reality He was nothing better Always dreaming Always thinking himself far above the rabble Yet failing to do Anything tangible At last taking recourse to poetry He thought to salvage What was left in him And tried to create a small riche.
তেত্রিশ বছর হল, ‘মাই লুনাসি’-র কবি আর নেই। আছে তাঁর কবিতাগুলো। হয়তো আরো কিছুদিন থাকবে। তারপর? ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়।’ শুধু নট বা নটীরাই নয়, কালে কালে সবাই সবকিছু হারায়। কেউ দুদিন আগে, কেউ দুদিন পরে। মহাকালের কাছে দুদিন আগে, দুদিন পরের মধ্যে কোনও ফারাক নেই!