এক সময় ছিলেন সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী। বহুদিন হল তিনি সর্বক্ষণের সাংস্কৃতিক সংগঠক। আবাল্য গান শুনতে শুনতে ও গাইতে গাইতে গান বাসা বেঁধে আছে তাঁর অস্তিত্বের সবখানে। আবার বাল্যকাল থেকেই নাটক দেখতে দেখতে এক সময় নিজেই অভিনেতা হয়ে গেছেন। তিনি গান লেখেন, ছড়া লেখেন, কবিতা লেখেন, কবিতা বলেন, নাটক লেখেন, ছোটগল্প লেখেন, গানে সুর দেন, নাটক ও সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেন, তথ্যচিত্র বানান (অন্তত একটা তো বানিয়েইছেন তাঁর অন্যতম দীক্ষাগুরু হৃষীকেশ সাউকে নিয়ে), সর্বত্র গান গেয়ে বেড়ান, নতুন শিল্পীদের পাদপ্রদীপের তলায় এগিয়ে দিতে জানপ্রাণ লড়িয়ে দেন, অখ্যাত গ্রামীণ গুণী লোকসংগীত শিল্পীকে হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে দেন গানের বিস্তৃত আঙিনায়, নাওয়াখাওয়া ভুলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে লোকগান সংগ্রহ করেন, লোকসংস্কৃতি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন, এক ঝাঁক নবীন শিল্পীকে লোকগানের পাঠ ও তালিম দিয়ে বাংলার নানা আঙ্গিকের লোকগানের ধারায় বারিসিঞ্চনে সহায়তা করেন, সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লেখেন, সারা পশ্চিমবঙ্গে চরকির মতো ঘুরে বেড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক পন্থার পক্ষে বক্তৃতা করেন, প্রয়োজনে সিনেমাতেও অভিনয় করেন। আমাদের সমকালে, একই অঙ্গে এত রূপ যাঁর, তাঁর নাম শুভেন্দু মাইতি না হয়ে অন্য কিছু হতেই পারে না।
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা উপেন্দ্রনাথ মাইতি, মায়ের নাম যোগমায়া মাইতি। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়ার সূত্রপাত। আশদতলা বিনোদ বিদ্যাপীঠ থেকে ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। কলকাতার সিটি কলেজ (মির্জাপুর শাখা)-এর নৈশ বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স নিয়ে বি কম (পার্ট ওয়ান) পাশ করেন। তাঁর প্রথাগত পড়ালেখার ওখানেই সমাপ্তি।
এর পরের পর্বে চাকরি নিয়ে শুভেন্দু মাইতি ভুটান চলে যান। প্রথমে থিম্পু, পরে ফুন্টশিলিং-এ অডিটর হিসেবে কাজ করেন। কিশোর বেলাতেই রাজনীতিতে দীক্ষাপ্রাপ্ত তাঁর ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’ তখন রাজনীতির দামামা অবিরাম বেজে চলেছে। তাই, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই তিনি ভুটানে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার কাজে নেমে পড়লেন। থিম্পু থেকে ফুন্টশিলিং-এ বদলি হয়ে এসেছেন যখন তখন একদিন (১৯৬৯ সালের অক্টোবরে) তিনি রাজনীতি করার জন্য ভুটান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তাঁর মুক্তির দাবিতে জলপাইগুড়ির চা শ্রমিকেরা ভুটান সীমান্তে অবরোধ শুরু করলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভুটানে রসদ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভুটান পুলিশ তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তবে শর্ত অনুযায়ী, এখনো তাঁর ভুটানে প্রবেশ নিষেধ। কিছুদিন পরে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন।
চাকরি ছাড়ার পরে আলিপুরদুয়ার, কুচবিহারে থাকলেন কিছুদিন। এই উত্তরবঙ্গ পর্ব তাঁর জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত কলকাতায় কাটিয়ে ১৯৭৯ সালে নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র মেদিনীপুরে ফিরে গেলেন। প্রথমে নন্দীগ্রামে ও পরে হলদিয়াতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আকণ্ঠ ডুবে থাকলেন। পরে আবার কলকাতায় চলে এলেন। শুভেন্দু মাইতির এর পরের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা।
সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এক সময় তিনি গান গেয়ে বেড়িয়েছেন আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। গানের টানে গেছেন মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশে। বেশ কয়েকবারই গান গাইতে বাংলাদেশে গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান গেয়ে চাঁদা তুলতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানোর জন্য। যেখানেই গান গাইতে গেছেন, সেখানকার সংগীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের তিনি স্থায়ী সম্পর্কের বাঁধনে বেঁধে নিয়েছেন।
আজ থেকে কমবেশি তিন দশক আগে, বাংলা গানের জগতে যখন এক ধরনের নতুন গানের জোয়ার আসে, তখন তিনি অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সেই নতুন গানের প্রবাহে নিজেকে যুক্ত করেন। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে আসা এই ‘জীবনমুখী’ গানের ধারায় শুভেন্দু মাইতি ‘ভগীরথের ভূমিকা’-য় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সুমন চট্টোপাধ্যায় (ইনি তখনো কবীর সুমন হননি), নচিকেতা, লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্যদের অকৃপণভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁর নিজের কথায়, “সুমন, নচিকেতা, শ্রীকান্ত, লোপামুদ্রা– এদেরকে জনসমক্ষে এনেছি। ক্যাসেট, রেকর্ড বের করতে সাহায্য করেছি।” এঁদের গান রেকর্ডিংয়ের জন্য রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তখনকার তাঁর সেই সফল উদ্যম-উদ্যোগের কথা পরবর্তীকালের এই জনপ্রিয় শিল্পীরা সোচ্চারে স্বীকার করেন। এঁদের বাইরেও কত শিল্পীকে তিনি প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছেন ও করে চলেছেন তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সাধ্যাতীত।
এরই মাঝে তিনি লোকসংগীত শিল্পী তাপসী রায়চৌধুরির সঙ্গে ২০০২ সালে নৈহাটিতে তৈরি করেছেন লালন আকাদেমি। এই আকাদেমির প্রাণপুরুষ রূপে তাঁর ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সারাজীবন ধরে তাঁর সংগ্রহ করা পনেরো হাজারেরও বেশি লোকগান লালন আকাদেমির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। লোকসংস্কৃতি গবেষণার ক্ষেত্রে লালন আকাদেমি এখন এক উল্লেখযোগ্য নাম।
দু-বার নাট্য আকাদেমির পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পী অনেক নাট্যদলের নাটকে সংগীত পরিচালনা করেছেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অনেক নাটকের সঙ্গেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। যুক্ত থেকেছেন ‘সায়ক’, ‘বহুরূপী’, ‘নটপীঠ’, ‘রাজা সাজা’, ‘সমীক্ষা’,’ কল্যাণী’, ‘গোবরডাঙা নকশা’, ‘কলামণ্ডপম’, ‘পরম্পরা’ (নদীয়া), ‘ঋত্বিক’ (বহরমপুর) প্রভৃতি নাট্যদলের নাটকের সঙ্গেও।
রাজা সেনের ‘মায়ামৃদঙ্গ’ ছবিতে অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন।
তরুণ মজুমদারের ‘ডাক দিয়ে যাই’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। তুখোড় অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ওই কবির লড়াই-এর দৃশ্য দেখার জন্য ‘ডাক দিয়ে যাই’ বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।
এবার তাঁর লেখা গানের একটা নমুনা পেশ করা যাক।
মইনুদ্দিন কেমন আছ বড্ড বেশি ঘুম পাচ্ছে? মইনুদ্দিন ঘুমকে তাড়াও সময় এখন খ্যামটা লাচছে। মইনুদ্দিন জেগে আছ সময়গুলো পিছলে যাচ্ছে মইনুদ্দিন জোর পা চালাও ধর্ম এখন মানুষ খাচ্ছে। মইনুদ্দিন মইনুদ্দিন মইনুদ্দিন বাঘের ছানা ফেউগুলো আজ হাঁকড় ছাড়ছে বাঘের ঘরে ঘোগের ছানা। মইনুদ্দিন যাচ্ছ কোথায় এতই সহজ পালিয়ে বাঁচা তোমার জন্য তৈরি আছে শক্ত-পোক্ত বাঘের খাঁচা বাঘের খাঁচা, বাঘের খাঁচা, বাঘের খাঁচা দেশটা জুড়ে মইনুদ্দিন রুখে দাঁড়াও মাথা তোল আকাশ ফুঁড়ে।
এর পর তাঁর কবিতার নমুনা পেশ করব। তাঁর কবিতা খুব বেশি প্রচারিত নয় বলে, তাঁর দু-রকম দুটো কবিতা পেশ করছি। প্রথমে একটা প্রেমের কবিতা।
বকুলফুল তুই কি বৃষ্টি হয়ে ঝরবি তুই কি আমার সাথে মরবি বকুল ফুল? তুই কি একটু ভুল করবি খোঁপায় পলাশ ফুল পরবি আগুন লাল? আগুনে লাল ফুলেই থাকে জ্বালা শুধু হুলেই থাকে মানিস তুই? তোকে যদি একটু ছুঁই গনগনে হয় মনের ভুঁই পুড়তে থাকি? পুড়তে পুড়তে উড়তে থাকি উড়তে উড়তে খুঁড়তে থাকি খুব গভীরে অবশেষে দু'চোখ বুজে হঠাৎ তোকে পেলাম খুঁজে অশ্রুনীরে।
এবার ছেঁড়া কাঁথা, খালি পা খালি পেটের কবিতা। কবিতার নাম ‘স্বপ্ন‘।
খালি পা খালি পেট বুকের ভিতরটা কিন্তু খালি না সেখানে ভিড় করে থাকে রাশি রাশি স্বপ্ন। ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছেগুলোকে পরপর সাজিয়ে নিই তাতেই তো আশার সৌধটা বেড়ে ওঠে। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা, হুঁ। বলেছিল একজন। ওরা তো বোঝে না ছেঁড়া কাঁথাটা যখন আরও ছিঁড়ে যায় স্বপ্নটা তখন আরও--আরও বড় হয়ে ওঠে।
অনেকে বলেন, একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যাপারে যুক্ত থাকার জন্য তাঁর গায়ন প্রতিভার ক্ষতি হয়েছে অনেক। তাঁর যে গায়ন ক্ষমতা ছিল, অনেক ঘাটে ঘটকালি করার কারণে তা পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারেনি। হবেও বা। তবে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলার কেউ নই। শুধু এটুকু বলতে পারি, বহুদিন বহু আসরে তাঁর নানা রকম গান শুনে আপ্লুত হয়েছি। আর স্বয়ং শুভেন্দু মাইতি এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। বহু মানুষের সঙ্গে থেকে, বহু মানুষকে ভালোবেসে, সবার কাজে সবার মাঝে থাকতেই তাঁর আনন্দ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শিল্পী শুভেন্দু মাইতি তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি-র ছবিটা এই লেখায় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।