যে বাড়ির নাম ‘বনতোষণী’, সে বাড়ির বাসিন্দা একজন কবি নন সেটা হতেই পারে না। হ্যাঁ, রায়গঞ্জের এই সুন্দর নামের বাড়ির অন্যতম বাসিন্দা ব্রততী ঘোষ রায় উত্তরবঙ্গের একজন বিশিষ্ট কবি। কবি, গণসঙ্গীতকার, শিক্ষাবিদ, পত্রিকার সম্পাদক ও সংগঠক অধ্যাপিকা ব্রততী ঘোষ রায় দুঃখের বিষয়, তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। গত এগারোই অগাস্ট মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অজ্ঞান হওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি তাঁর। অজ্ঞান অবস্থায় সারাদিন সারারাত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত বারোই অগাস্ট ভোরে এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি প্রয়াত হন। চুয়াত্তর বছর বয়স হয়েছিল তাঁর।
ব্রততী ঘোষ রায়ের জন্ম জলপাইগুড়ি শহরে। বাবার নাম যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও মায়ের নাম শুক্লা চক্রবর্তী। ওঁরা আদতে দিনাজপুরের কালীতলার বাসিন্দা। কর্মসূত্রে জলপাইগুড়িতে আসা ও থাকা। তাঁর স্কুলের লেখাপড়া শিলিগুড়ি জ্যোৎস্নাময়ী গার্লস স্কুলে। কলেজের শিক্ষা জলপাইগুড়ি পি ডি উইমেন্স কলেজে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ করে 1969 তিনি সালে রায়গঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগে পড়াতে ঢোকেন। ওই বছরেই কলেজের সহকর্মী অধ্যাপক দিলীপ ঘোষ রায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পড়াতে পড়াতে পিএইচডি করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলা উপন্যাসে পল্লীসমাজ।
মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর কবিতা লেখার সূচনা। সারা জীবন লিখেছেন অজস্র কবিতা ও ছড়া। বেশ কিছু গণসঙ্গীতও লিখেছেন তিনি। লিখেছেন অনেক অণুগল্প। সম্পাদনা করেছেন ‘উদ্ভাস’, ‘মাটির বাড়ি’, ‘উত্তরবঙ্গের প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকা। উত্তরবঙ্গের অসংখ্য ছোট পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বহুদিন ধরে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দেশ’, ‘পরিচয়’, ‘অমৃত’, ‘নন্দন’, ‘একসাথে’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘মুছে যাক পরিতাপ’, ‘স্বর্ণলতা ছিঁড়ে যাক’, ‘এই একটু আমি’ ‘মৃৎপাত্রে ছবি’, ‘অন্নসুন্দরী’, ও ‘চতুর্থ সূত্রের খোঁজে ভেজা পুঁথি’। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর অনেক কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে, যেগুলো সংকলিত হলে অনায়াসে আরো বেশ কয়েকটা কবিতার বই হয়ে যাবে।
তাঁর ছড়ার হাত ছিল অতি চমৎকার। ছোটদের জন্য সহজ সরল ছন্দে লেখা তাঁর ছড়া সব পাঠকের মন কেড়ে নেয়। ‘সূয্যি নিবি আয়’ তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় ছড়ার বই।
সংগঠক হিসেবেও তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। সারা জীবন নানা কাজে অনেক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বাড়িতে নিয়মিত সাহিত্যসভার আয়োজন করতেন। পনেরো দিন অন্তর অনুষ্ঠিত ‘প্রতিপক্ষ’ নামের ওই সাহিত্যসভা উত্তরবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকদের মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসা শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের ভালোমন্দ সবকিছুর সঙ্গে ওতপ্রাত জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ছাত্রছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাড়িতে আসর বসাতেন। সেই অনাবিল আনন্দের আসরে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় অধ্যাপিকার সাহচর্যে কথায় গানে কবিতায় ঝলমল করে উঠত। তারই মাঝে, ব্রততীদির শিক্ষক সত্তা অনেক ছাত্রছাত্রীকে জীবন অন্বষণের মন্ত্রে উদ্বোধিত করত।
অত্যন্ত স্নেহশীল এই মানুষটির কাছে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ছিল অত্যন্ত আদরের। তাদের নিয়ে তাঁর কতনা ভাবনা, কতনা পরিকল্পনা। পাড়ার ছোটদের ভালোবেসে তৈরি করেছিলেন তাদের নিজস্ব সংগঠন ‘সবুজ কলি’। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কচিকাঁচাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানোর জন্য তাঁর ধৈর্যশীল প্রয়াস নিত্য ক্রিয়াশীল ছিল।
তাঁর বাড়ির আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মানুষদের নিয়েও তিনি সংগঠন গড়েছিলেন। এই সংগঠনের নাম দিয়েছিলেন ‘মাটির বাড়ি।’ গ্রামের গরিব মানুষেরা তো মাটির বাড়িতে থাকেন– তাই এই নাম। নিজেদের প্রয়োজনে গ্রামের মানুষগুলো মিলেমিশে থাকবে, একজন আর একজনের দরকারে ও বিপদে আপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, এই ভাবনা থেকেই এই সংগঠনের জন্ম। দুঃস্থদের সাধ্যমতো ওষুধ, জামাকাপড়, কম্বল দিয়ে সাহায্য করত এই সংগঠন।
ব্রততীদি তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা ও সমাজচেতনা দুই-ই নিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতার ভাষা, চিত্রকল্প কোনোটাই আরোপিত নয়। শিল্পীর তুলির আলতো আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা ছবির মতো তাঁর কবিতা তাঁকে কবি হিসেবে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা তাঁর কবিতায় প্রতি মুহূর্তে জীবনকে ছুঁয়ে আছে। তাঁর নীচের কবিতাটা দেখুন।
ভেতরে বাইরে
স্বপ্নের ভেতরে আর ভেতর থেকে বাইরে দিব্যরঙের এত খোঁজ দেখি রূপমশলার দিন তোলপাড়। বিকাশ জানে, একমুখিতা ভালো, পর্দা ছায়া যা থাকে সব খোলা-- চার পাঁচটা বাড়ি চিত্র, উঠোন শিল্প ঢেঁকিশালের কথাচর্চা যত ব্যাগ্রে বিল বন্দী হোক সব ঘরকথাদের ছবি হয় না। তার জন্যে রেল লাইনে খুব সম্ভ্রমে দূরপাল্লার গতি, ফাঁকা ব্রিজেরও শব্দ গ্রহণ স্বপ্ন শুরুর লোককথার নিলাম লিখেও দায় দেয়নি কোনো বাজারে, বাজার বাজার, ভ্রম বোঝেনি, নাশ বোঝেনি এত দূষণ, শবদাহ যে তারই ভেতর। স্বপ্ন ঠেকে শিখেছে সার অনুবাদের মোহিত রসে ঢেউ ডুবলে ডুববে শ্রবণ, দর্শন আর আনুষঙ্গিক যত প্রশাখা।
পড়তে পড়তে মন চলে যায় দূর নীলিমায়। আবার ‘শবদাহ’-র ঊর্ধগামী আগুনের শিখা আমাদের টেনে নামায় এই মাটির পৃথিবীতে।
পশ্চিমবঙ্গের লোধা শবর সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা স্নাতক চুনি কোটাল। চুনি স্নাতক হওয়ার পরে তাকে নিয়ে সংবাদপত্রে কম লেখালেখি হয়নি। চুনি আর একবার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছিল– যখন সে আমাদের এই বর্ণবাদী সমাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করেছিল। চুনিকে নিয়ে লেখা ব্রততীদির একটা কবিতা আছে যা পড়ে বোঝা যায় কত গভীরভাবে তিনি চুনিদের জীবনযন্ত্রণাকে বুঝতে পেরেছিলেন।
চুনি কোটাল
জামায় এত ফুল দেখেছিস মা, যেতে যেতে গায়ে আঁকলি ইলিবিলি ডাল, কুচো পাতার বাদাড় আঁচল সামলে মা তুই যাস কোথায়? যায় কোথায়? পরবাস থেকে তোর বনবাসে এলাম মা, মা তুই বনবিবি হবি? তোর চরণ ছুঁয়ে বনে সিঁধবো আমি গোলপাতা আর মধু খুঁজব, খেজুর ডাল কেটে ছড়ি বানাবো। তোর থানে দুই মোরগ চড়াত আমার বাপ আমার জেবে পাখা তড়পাচ্ছে পাশ করার দুটো কাগজ কালিতে উল্কি ফোটানো পাকা ছাপ দেওয়া এ সব উছলে দেব তোর চরের সূলায় হরিণে জল খাওয়া নদীর কাদায়, নাগ ছোবলে নীলবর্ণ রাত-জোছনা বাঘের দন্তে ঝিলমিল করে মা তোর বন ঘরে, আমার কলেজ পাশের উল্কি সারা গায়ে লিখল নীলবর্ণ আমার চোখের সাদায় দংশে তারা আমাকেও সাপ বানায় আমি সাপ হব না মা। দখিন রায়ের ক্রোধী বহিন বনবিবি তোর রক্ত বরণ কন্যে হব মা বনঘরে হাঁটব বাঘিনীর মতো।
শেষে যে কবিতার কথা বলব, সেটি কবির প্রয়াণের পরে প্রকাশিত। কবিতাটি ‘নন্দন’ পত্রিকার দফতরে এসে পৌঁছেছিল তাঁর প্রয়াণের অল্প আগে। কবিতাটি পড়তে পড়তে আমরা দেশ-কাল-এর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আপ্লুত হতে থাকি। অত্যন্ত গভীর ও সার্থক কবিতা এটি।
দশদিন দশরাতের পর
গত দশদিন হয়ে গেল তারাদের দেখা পাইনি। তাদের সঙ্গে কথা হয়নি প্রশ্নের মত কত ভুল চিহ্নে দাগ দিচ্ছি-- ভুলের মত কত ফুল ঝরে যাচ্ছে আলোরাও জ্বলে নিভে আমার ভুল ধরছে অথচ দশদিন হয়ে গেল কোনো তারা আসেনি ঘরের জানলা দিয়ে শুধুই কুয়াশার মতিভ্রম ঠমক তুলে চলে যাচ্ছে কালো নদী একটু জলস্পর্শ পর্যন্ত করতে পারছি না হিম সকালে ভাবি আর কয়েক ঘণ্টা পার হোক রাত গভীরে বলি আর কত দেরী সকালের চক্রের মত ঘুরতে থাকা দিন রাতের প্রহরায় আমি আমার হাতে এখন কিছুই নেই না ফুল না তারা না নদী অথচ জানি আকাশে বড় প্রশ্ন নিয়ে সপ্তর্ষি আছে অথচ দশদিনে একটি বারও তারার মুখ দেখিনি শূন্য কি এতই সুলভ দশদিন দশরাতের এই প্রশ্ন।
ব্রততীদির সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনওদিন। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, তারাদের দেশে গিয়ে, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কি তাঁর!
Pingback: সবাই যদি - Ari Mitra's Diary