আসল কথা

books, bookstore, book

আমি যে কলেজে কেরানির চাকরি করি, সেই কলেজে সাগর মিত্র ইংরেজির অধ্যাপক। তিনি অধ্যাপক হিসেবে কেমন তা আমি জানি না, তবে কবি হিসেবে যে তিনি কিঞ্চিৎ খ্যাতিমান তা জানি। আমি অল্পবিস্তর ছড়া লিখি বলে সাগর মিত্র আমাকে একটু স্নেহও করেন। আমি সামান্য কেরানি হলেও তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতে আমাকে মানা করে দিয়েছেন। তাঁকে আমি সাগরদা বলেই ডাকি।

       সাগরদা একদিন কলেজের অফিস ঘরে এসে আমাকে একটা শিশুপাঠ্য ছড়ার বই উপহার দিলেন। বইটা দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও, বই উপহার পাওয়ার আনন্দে আমি উদ্ভাসিত হই। আমার আনন্দিত হওয়ার আর একটা কারণ ছিল। বইয়ের টাইটেল পেজে সাগরদা তাঁর সুন্দর হাতের লেখায় লিখে দিয়েছেন, ‘প্রিয় ছড়াকার রতন ঘোষকে।’ তলায় তারিখসহ তাঁর নামসই। ‘প্রিয় ছড়াকার’ লিখে কেউ বই উপহার দিলে খুশি হবে না, এমন কোনো ছড়াকার বঙ্গদেশে আছে বলে আমার জানা নেই। সুতরাং খুশিমনে সাগরদাকে যথাবিহিত ধন্যবাদ জানিয়ে বইটা গ্রহণ করি। সাগরদা ছড়া নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করে টিচার্স রুমে ফিরে যান।

       এর বছর পাঁচেক বাদে সাগরদা একদিন আমাকে বললেন, কোনো এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতার জন্য তাঁকে ছড়া ও কবিতা বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই, তিনি আমাকে ছড়ার যে বইটা উপহার দিয়েছিলেন, সেই বইটা তাঁর দিন কয়েকের জন্য লাগবে। আমি তাঁকে বলি, ‘বইটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগবে– অন্তত দু-তিন দিন।’ সাগরদা বললেন, ‘তা হবে না। ইট ইজ ভেরি আরজেন্ট। আগামী কালই বইটা চাই।’

      আমি আর কী করি! বাড়িতে তখুনি ফোন করে বাঁশরিকে বইটা খুঁজে রাখতে বলি। বাঁশরি বলল, বইয়ের পাহাড় থেকে একদিনে ওই বই খোঁজা তার কর্ম নয়। তার চেয়ে বরং বিকেলে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বইটা এনে রাখবে। আমি হাঁফ ছেড়ে বলি, ‘তথাস্তু!’

        সন্ধেবেলা বাড়ি গিয়ে দেখি, বইটা বাঁশরি পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এনে রেখেছে। যাতে ভুলে না যাই, সেজন্য তৎক্ষণাৎ বইটা অফিসের ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলি।

         পরদিন কলেজে গিয়ে টিচার্স রুমে যাই। দেখি সাগরদা কী সব লিখছেন। বইটা আমার হাত থেকে নিয়েই তিনি বললেন, ‘এ কী বই এনেছ! এই বই তো আমি চাইনি।’

        আমি বলি, ‘সাগরদা, এই বই-ই আপনি আমাকে গিফট করেছিলেন।’ সাগরদা গলা চড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই বই-ই, বাট্ নট দিস কপি। হোয়্যার ইজ মাই সিগনেচার অন দ্য টাইটেল পেজ?’ এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হল। সাগরদা ওই বইয়ের যে কপিটা আমাকে উপহার দিয়েছেন, সেটাই তাঁর চাই। আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘আপনার তো দরকার এই বইয়ের ছড়াগুলো, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার….’

        আমাকে থামিয়ে দিয়ে সাগরদা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ‘আই ওয়ান্ট দ্যাট কপি, অ্যান্ড দ্যাট কপি ওনলি, এবং কালই।’ আমি জড়সড় হয়ে বলি, ‘অন্তত দুটো দিন সময় দিন।’

         সাগরদা খেঁকিয়ে উঠে বলেন, ‘নট মোর দ্যান ওয়ান ডে! বড়োজোর কালকের দিনটা তুমি পাচ্ছ।’ আমি আর কী করি! অগত্যা তাতেই রাজি হয়ে টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে আসি।

         অফিস ঘরে ফিরে এসে বাঁশরিকে ফোন করে বইটা খুঁজতে বলি। শুনে বাঁশরি জানতে চাইল, লাইব্রেরি থেকে বইটা আনার পরেও ওই বইটা খুঁজতে হবে কেন। আমি আনুপূর্বিক সাগরদার কথাগুলো বলে তাকে বইটা খোঁজার সনির্বন্ধ অনুরোধ করি। বাঁশরি বলল, খুঁজবে, কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারছে না, যে একদিনের মধ্যে বইটা খুঁজে পাবেই।

         বাঁশরিকে দোষ দেওয়া যায় না। বাড়িতে বই যে রকম অগোছালোভাবে রাখা থাকে, তাতে কোনো বই এক হপ্তার আগে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতেই বাঁশরি ফেলিওর রিপোর্ট দিল এবং বলল, আগামী কালও যে বইটা খুঁজে পাবে তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছে না। 

          রাতে খাওয়ার পরে শুতে যাব, এমন সময় সাগরদার ফোন, ‘বইটা কাল পাচ্ছি তো?’

         আমি বললাম, ‘না।’

         ‘পরশু?’ সাগরদার গলা বজ্রময় হয়ে ওঠে। 

         আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, পাবেন।’

         শুনে বাঁশরি বলল, ‘কী করে পাবেন? আমি কি বলেছি, বইটা কাল খুঁজে পাবই?’

          আমি বললাম, ‘তোমাকে খুঁজতে হবে না।’

          বাঁশরি গলায় ছুরির ধার এনে বলল, ‘তার মানে?’

         আমি বললাম, ‘তার মানে কাল আমি অফিস ডুব দেব। সারাদিন ধরে যেভাবেই হোক, বইটা খুঁজে বার করবই।’

          বাঁশরি গজগজ করতে করতে বলল, ‘সাগর মিত্রের বই খোঁজার জন্য একটা সি এল নেবে; অথচ ক-দিন আগে আমি যখন বেলুড় মঠ যাওয়ার জন্য একটা সি এল নিতে বললাম, তুমি রাজি হলে না।’ আমি আর কী করি! অনেক অনুনয় বিনয় করে আগামী এক হপ্তার মধ্যে সি এল নিয়ে বাঁশরিকে বেলুড় মঠ ঘুরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গৃহশান্তি রক্ষা করি।

        পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বাজার করে সামান্য একটু জলখাবার খেয়ে সাগরদার বই খুঁজতে থাকি। খুঁজছি তো খুঁজছিই! বই আর পাই না। এই আলমারি খুঁজি, সেই আলমারি খুঁজি। বিভিন্ন তাকে থেকে বই বার করি আর ঢোকাই। এই করতে করতে ঘণ্টা পাঁচেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দেড়টা নাগাদ বইটা খুঁজে পেয়ে সাগরদাকে ফোনে খবর দিলাম। সাগরদা সন্দিগ্ধ গলায় জানতে চাইলেন, ‘ওই কপিটাই তো?’

         আমি বলি,’হ্যা।’

         সাগরদার সন্দেহ তবুও যায় না। বললেন, ‘ওতে আমার সই আছে? সইয়ের নীচে ‘এত’ তারিখ?’

        আমি আঁতকে উঠি! পাঁচ বছর আগের একটা মামুলি তারিখ সাগরদার তখনো মনে আছে! তাঁর স্মৃতিশক্তির তারিফ করে বলি,’হ্যাঁ, ওই তারিখই।’

       সাগরদা তখুনি বইটা আমার অফিসের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতে বললেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো তাই করলাম।

     পরদিন বইটা হাতে নিয়ে পরখ করে সাগরদা নিশ্চিত হলেন, যে ঠিক বইটাই তাঁকে দিয়েছি। হেসে বললেন, ‘তুমি আমাকে বাঁচালে ভাই।’ আর কথা না বাড়িয়ে হাসতে হাসতে আমি নিজের কাজের জায়গায় ফিরে আসি।

      তারপর কালের নিয়মে দিন কেটে যায়। বইটার কথা ভুলেই গেছি। হঠাৎ একদিন বইটার কথা মনে পড়ে। হাজার হোক উপহার পাওয়া বই। সুযোগ মতো সাগরদার কাছে কথাটা পাড়ি।

      সাগরদা নির্লিপ্তভাবে বললেন, ‘বইটা আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন পাওয়া যাবে না, তা জিজ্ঞেস করো না।’

        আমি সামান্য কেরানি, আর কথা বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। মনটা একটু খারাপ হয়। কিন্তু কী আর করা যাবে!

        ওই দিনই সন্ধেবেলা কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে ওই বইয়ের একটা কপি কিনে বাড়ি ফিরি। পরের দিন কী হল জানি না, বইটা কলেজে নিয়ে যাই। আমার হাতে বইটা দেখে সাগরদা বললেন, ‘কিনলে?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ, আসলে বইটা বহুদিন ধরে বাড়িতে ছিল, মনের মধ্যে একটু মায়া পড়ে গিয়েছিল।’ সাগরদা বললেন, ‘আরে এতে সঙ্কুচিত হওয়ার কী আছে! আই নো দ্যাট ইউ আর আ বুক লাভার। কিনেছ, ভালোই করেছ।’ তারপর বললেন, ‘বইটা দু-দিনের জন্য দেবে আমাকে?’ আমি বললাম, ‘দেব, কিন্তু কী করবেন এই বই নিয়ে?’ সাগরদা বললেন, ‘সেটা বলা যাবে না।’

      আমি সাগরদাকে দু-দিনের জন্য বইটা দিই। দু-দিন বাদে সাগরদার কাছে বইটা ফেরৎ নিতে গেছি। সাগরদা বললেন, বইটার টাইটেল পেজে তিনি ‘প্রিয় ছড়াকার রতন ঘোষকে’ লিখে তারিখসহ সই করে দিয়েছেন। কিন্তু তখন তাঁর টানাটানি যাচ্ছে, তাই বইটার দাম দিতে পারবেন না। 

       আমি অধোবদন হয়ে বলি, ‘না না, আপনি দাম দেবেন কেন?’ সাগরদা বললেন, ‘ওই যে যা লিখে দিয়েছি তাতে মনে হবে, যে বইটা আমি তোমাকে গিফট করেছি। তাই বইয়ের দামটা দিতে পারলে ভালো হ’ত।’

       আমি বললাম, ‘তাতে কী, আপনি লিখে দিয়েছেন, তাতেই আমি খুশি।’

       একথা সেকথার পর সাগরদা তাঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে বইটা বার করে আমার হাতে দিলেন। 

       বইটা হাতে নিয়ে সাগরদার লেখাটা দেখার জন্য বইটা খুলতেই টাইটেল পেজটা খুলে সাগরদার টেবিলে পড়ে গেল। আঁতকে উঠে সাগরদা বললেন, ‘গেল গেল, সব গেল!’ কী গেল বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি বললাম, ‘কী গেল সাগরদা?’ সাগরদা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘ওফ্! ইট হ্যাজ নট বিন পেস্টেড, ইট হ্যাজ নট বিন পেস্টেড!’ কাঁচুমাচু মুখে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী পেস্ট করা হয়নি সাগরদা?’

      সাগরদা নিজেকে সামলে নিয়ে বইটা আমার হাত থেকে নিলেন। টাইটেল পেজটা টেবিল থেকে তুলে বইটাতে ঢুকিয়ে বললেন, ‘এখানে হবে না। চলো, একটু পাঁচুর দোকানে যাই।’ বলে নিজের ঝোলা ব্যাগটা হাতে নিয়ে কলেজের গেটের বাইরে পাঁচুর চায়ের দোকানের দিকে হাঁটা লাগালেন। আমি নীরবে তাঁকে অনুসরণ করলাম।

     থমথমে মুখে সাগরদা পাঁচুর দোকানের এক নির্জন কোণে বসলেন। আমি তাঁর উল্টোদিকে চুপচাপ বসে থাকি। সাগরদা ব্যাগ থেকে আঠা বার করে নিপুণ হাতে টাইটেল পেজটা বইয়ে জুড়ে দিলেন। দেখে কার সাধ্য বোঝে, যে টাইটেল পেজটা খুলে পড়ে গিয়েছিল। জোড়া হয়ে যেতে বললেন, ‘এই নাও তোমার বই।’

       আমি নীরবে বইটা ফেরৎ নিই।

       সাগরদা এরপর পাঁচুকে দু-প্লেট মরিচ টোস্ট ও দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। দিয়ে আমাকে বললেন, ‘জানো, কী হয়েছিল?’ আমি বললাম, ‘না, জানি না। ‘

        সাগরদা বললেন, ‘না বললে তুমি জানবেই বা কী করে! আরে, বই নিয়ে এমন বিপদে কোনওদিন পড়িনি।’ আমি হাঁ করে শুনতে থাকি।

         সাগরদা বললেন, ‘প্রায় ছ-বছর আগে ওই বইটা তোমাকে কেন দিয়েছিলাম, তা তুমি জানো?’

         আমি বললাম, ‘না, জানি না।’

         সাগরদা বললেন, ‘জানোই তো, আমাদের লেট ইস্যু। আমার যখন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স, তখন আমার ছেলের জন্ম। যেদিন ওর পাঁচ বছর পূর্ণ হয়, সেদিন ওই বইটা ওকে দেব বলে কিনে নিয়ে যাই। ওই বই দেখে তোমার বউদি বলেন, ‘এ বই চলবে না। এখন সায়েন্সের যুগ। ছড়া-কবিতার বই ছেলেকে দেওয়া চলবে না।’

       আমি বলি, ‘তারপর?’

       ‘তারপর আমি ছেলের জন্য নানা রকম সায়েন্টিফিক খেলনা কিনে নিয়ে যাই। তোমার বউদি খুব খুশি হন, আমারও ফাঁড়া কেটে যায়।’

      আমি কাঁদব না হাসব, বুঝতে পারি না। বোকা বোকা মুখে টোস্ট চিবোতে চিবোতে বলি, ‘তারপর?’

       সাগরদা বলেন, ‘এদিকে ছেলের বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই ওর মুখে ছড়া-কবিতার খই ফুটতে দেখে তোমার বউদি ওই বইটা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। না পেয়ে আমার ওপর হুলিয়া জারি করে দু-দিন ছুটি নিয়ে বইটা খুঁজে দিতে বলেন।’

      সাগরদার কথা শুনে চিবোনো টোস্ট আমার গলায় আটকে যায়। সাগরদা বললেন, ‘একটু জল খেয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে। ‘

        সাগরদার কথামতো আধ-গ্লাস জল খেয়ে আমি বললাম, ‘তারপর?’ সাগরদা বললেন, ‘তারপর আর কী! আমি তো জানি, বইটা তোমার কাছে আছে। দু-দিন ছুটি নিয়ে আমি বাড়িতে বইটা খোঁজার ভান করি। শেষমেশ আবৃত্তি প্রতিযোগিতার নাম করে বইটা তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিই।’ আমি বললাম, ‘বুঝেছি।’

        সাগরদা বলে চললেন, ‘সবই যখন বুঝেছ, তখন বাকিটাও শোনো। টাইটেল পেজে যেহেতু তোমার নাম লেখা ছিল, তাই বইটা ছেলেকে দেওয়ার আগে ওই পাতাটা ব্লেড দিয়ে কেটে আমার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিই। অ্যান্ড মাই বয়, যখন তুমি জানলে যে বইটা আর পাবে না, তুমি একটা নতুন বই কিনে কলেজে এলে। দেন আই গট দ্য আইড়িয়া। আমি তোমার নতুন বইটা দু-দিনের জন্য চেয়ে নিলাম।’

         আমি উৎকর্ণ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’

         সাগরদার ঝটিতি উত্তর, ‘তোমার বইয়ের টাইটেল পেজটা ব্লেড দিয়ে কেটে তার ওপরে ‘স্নেহের দেবদত্তকে– মামনি ও বাবা’ লিখে ছেলের সিক্সথ বার্থডে-র তারিখ বসিয়ে দিয়ে পুরনো বইয়ে সেঁটে দিই। আর তোমার নাম লেখা পুরনো বইয়ের টাইটেল পেজ তো আমার টেবিলের ড্রয়ারে রাখাই ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, পাতাটা পেস্ট করতে ভুলে গিয়েই যত বিপত্তি হল!’ সাগরদার টোস্ট ও চা তখনো টেবিলেই পড়ে আছে। সাগরদাকে টোস্ট খেয়ে নিতে বলি। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে দেখে আমি এক কাপ চায়ের অর্ডার দিই।

      টোস্ট খেতে খেতে সাগরদা বললেন, ‘এখন বুঝেছ তো শেক্সপিয়ার কেন বলেছেন, দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ আ স্টেজ।’

       আমি বললাম, ‘বুঝেছি।’

       কিন্তু তখনো আমার বোঝার বাকি ছিল। পরদিন সাগরদা আমাকে ফোন করে বললেন, ‘দেড়টায় পাঁচুর দোকান।’

       দেড়টার সময় পাঁচুর দোকানে গিয়ে দেখি, সাগরদা বসে আছেন।  আমি তাঁর মুখোমুখি বসলাম।

        সাগরদা বললেন, ‘তোমার কেনা বইয়ে আমি লিখে দিয়েছি– অ্যাজ ইফ বইটা তোমাকে গিফট করেছি, তারপর থেকেই মনটা খুব খচখচ করছে।’

        আমি সঙ্কুচিত হয়ে বলি, ‘সাগরদা, ওটা কোনও ব্যাপারই নয়। প্লিজ ভুলে যান।’

         সাগরদা বললেন, ‘ভুলে যান বললেই কি ভুলে যাওয়া যায়!’ বলে তাঁর সাইডব্যাগ থেকে একটা খুব পুরনো মলাট-ছেঁড়া বই বার করলেন। একজন বিখ্যাত বাঙালি কবির লেখা কবিতার ছন্দ ব্যাকরণ প্রকরণ নিয়ে বিখ্যাত বই। সাগরদা বইটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘টাইটেল পেজটা খুলে দ্যাখো।’

          বইটার টাইটেল পেজ খুলে দেখি সাগরদা লিখে দিয়েছেন, ‘প্রিয় ছড়াকার রতন ঘোষকে।’ নীচে তারিখসহ তাঁর নামসই। দেখি আগের সেই তারিখ। আমি আনন্দিত মনে সাগরদাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলি, ‘ওই তারিখটা আপনার এখনো মনে আছে!’ সাগরদা বললেন, ‘ওতে বাহাদুরির কিছু নেই। ওটা আমার ছেলের সিক্সথ বার্থ-ডে, তাই ভোলার প্রশ্ন নেই।’

          আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘তা ঠিক, তা ঠিক।’ সাগরদা বললেন, ‘বইটা ব্যাগে ঢোকাও। তুমি ছড়া লেখো, বইটা তোমার কাজে লাগবে। ‘

         সাগরদার বই গিফট করার আনন্দ যাতে কমে না যায়, সেজন্য ওই বইটা যে বহুদিন ধরেই আমার আছে তা চেপে গিয়ে সাগরদাকে বললাম, ‘আপনি নামি কবি, বইটা তো আপনারই বেশি লাগবে।’

          সাগরদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে, আসল কথাটাই তো তোমাকে এখনো বলা হয়নি। গতকাল বাড়ি ফিরতি কলেজ স্ট্রিট থেকে তোমাকে দেব বলে এই বইটার একটু নতুন কপি কিনে বাড়ি যাই। রাতে মনে হল, বড়ো হলে ছেলের লাগতে পারে বইটা।  তাই নতুন বইটা বাড়িতে রেখে পুরনো বইটাই তোমাকে দিলাম।’  সাগরদার আসল কথাটা শুনে আমার মনে হল, শেক্সপিয়ার পৃথিবীকে স্টেজ বলেছেন কেন, তা আমি কোনওদিনই বুঝতে পারব না।

        সাগরদা আর দেরি না করে কোথাও কবি সম্মেলনে কবিতা পড়তে যাবেন বলে উঠে পড়লেন। 

         আমি আর কী করি! পাঁচুকে এক প্লেট টোস্ট ও ঘুগনির অর্ডার দিয়ে, সদ্য উপহার পাওয়া বইটার পাতা ওল্টাতে থাকি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *