আজ থেকে সাড়ে তিন দশক আগে অমল, প্রদীপ, সুশীল ও আমাকে নিয়ে চার বন্ধুর একটা অন্তরঙ্গ দল ছিল। এই গ্যাং অফ ফোরে, একমাত্র আমিই ছিলাম গ্রাম থেকে আসা। বাকি তিনজন, যাকে বলে, কলকাতায় বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ্। অমল টালিগঞ্জ ও প্রদীপ গড়িয়াহাটের ছেলে। সুশীল বাগবাজারের ঝুনো নারকেল। কে জানে, ওদের সঙ্গে কী ভাবে ভিড়ে গিয়েছিলাম!
প্রদীপ কলকাতার একটা কলেজে অঙ্ক পড়াত। অমল দক্ষিণ কলকাতার একটা নামজাদা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক। সুশীল কলেজ স্ট্রিটের একটা সরকারী স্কুলে ইতিহাসের তুখোড় মাস্টার (ও নিজেকে মাস্টার বলতেই পছন্দ করত)।
অমল এমনিতে খুব শার্প। কিন্তু একটু বেশি রকম স্ট্রেট্ ফরোয়ার্ড। কোনও কথাই পেটে রাখতে পারত না। মাঝেমাঝেই বেফাঁস কথা বলে প্রদীপ ও সুশীলের হাসিমস্করার খোরাক হত। প্রদীপের আবেগ বলে কোনো বস্তু ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি ও জয়েন্টের ছেলেমেয়েদের সমান দক্ষতায় অঙ্ক, ফিজিক্স ও বায়োলজি পড়াত। প্রচুর ছেলেমেয়ে ওর কাছে টিউশন পড়ত। সুশীল নাম হলেও, সুশীল আদৌ সুশীল স্বভাবের ছিল না। গিরিশ ঘোষের রচনাবলীর অনেকটাই ওর মুখস্থ ছিল। কথায় কথায় গৈরিশ ছন্দে আসর মাতিয়ে রাখত। খুব খেতে ভালোবাসত! যখন তখন অতি সূক্ষ্মভাবে অমলের লেগ পুল করে মজা পেত।
প্রতি শনিবার সন্ধেবেলা এসপ্ল্যানেডে কে সি দাসের দোকানের দোতলায় আমাদের আড্ডা বসত। তার আগে অবশ্য চারজনে মেট্রো, গ্লোব কিংবা টাইগার-এ একটা ইংরেজি সিনেমা দেখে নিতাম। মাঝেমধ্যে কোনো হলে নাটক দেখে ওখানে এসে জুটতাম। যথেচ্ছ রাজাউজির মেরে এক সময় যে যার বাড়ির পথ ধরতাম।
একদিন কে সি দাসের দোতলার আড্ডায় অমলকে বেশ গম্ভীর মনে হল। মনে হল, কোনো একটা সমস্যায় পড়েছে। সুশীলের সামান্য চেষ্টাতেই ওর সমস্যাটা জানা গেল।
তখন ও সবে বিয়ে করেছে। ক-দিন হল, বাড়িতে একটা আনওয়ান্টেড ফোন আসছে। অমল ধরলে ফোন কেটে যায়। ওর স্ত্রী বিপাশা ফোন ধরলেই ওদিক থেকে উল্টোপাল্টা কথা বলে! বিপাশা ও অমল দুজনেই বেশ উদ্বিগ্ন! অমল আমাদের তিন জনের কাছে পরামর্শ ও সাহায্য চাইল।
প্রথমে সুশীল ব্যাপারটা হালকা করার জন্য অমলকে বলল, “তুই ফোনটা ছেড়ে দে। আমাদের কারো বাড়িতেই ফোন নেই, তাতে তো আর কিছু আটকে যাচ্ছে না। ফোনটা ছেড়ে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে এই উৎপাত মিটে যাবে।” আমরা কিছু বলার আগেই অমল বলল, “বাবা উকিল ছিলেন, ফোনটা সেই আমল থেকেই রয়েছে। বাবার স্মৃতি হিসেবে ওটা থাক।” প্রদীপ ও আমি অমলের কথায় সায় দিলাম।
তখন সুশীল প্রস্তাব দিল, আমরা তিনজন (সুশীল, প্রদীপ ও আমি) প্রত্যেকে একটা করে উপায় বাতলাব। আলোচনা সাপেক্ষে অমলের যেটা পছন্দ হবে, সেটাই করা হবে।
প্রথমে প্রদীপের পালা। প্রদীপ বলল, পুলিশের এক বড়ো কর্তার মেয়েকে ও পড়ায়। ওঁকে বললেই হবে; ব্যাপারটা সহজেই মিটে যাবে। পুলিশের সেই কর্তার নাম শুনে আমাদের ভরসা হল। বেশ দক্ষ ও সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে ওঁর সুনাম আছে।
এরপর সুশীলের টার্ন। ও খুব নিরীহ গলায় অমলকে বলল, “তুই রোদ্দুর হয়ে যা!”
অমল বলল, “তার মানে?”
— মানে খুব সোজা! বিপাশা ফোনে ওকে বাড়িতে ডাকুক।
প্রদীপ ভুরু কুঁচকে বলল, “ব্যাপারটা বোঝা গেল না।”
সুশীল বলল, “না বোঝার কিছু নেই। বিপাশা ফোনে একদিন বদমাশটাকে বাড়িতে আসতে বলবে। ওই দিন আমরা চারজন অকুস্থলে হাজির থাকব। বিপাশা আমাদের জন্য লুচি, মাংস বানিয়ে রাখবে। এলেই হারামজাদাকে এমন ঠ্যাঙান ঠ্যাঙাব যে, কোনও দিন আর বিপাশাকে ডিস্টার্ব করার সাহস দেখাবে না।”
প্রদীপ বলল, “মারামারির ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো।” বলে আমার দিকে চেয়ে আমার কী প্রস্তাব তা জানতে চাইল।
আমি বললাম, “আমার প্রস্তাবে ঝামেলা কিছু নেই, শুধু মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিংবা জন মিলটনের একটু শরণ নিলেই কার্যোদ্ধার হবে।”
প্রদীপ ওর চোখ দুটো ছোটো করে বলল, “একটু ঝেড়ে কাশো বাবা। এই ঝামেলার মধ্যে কবে মরে ভূত হয়ে যাওয়া কবিদের কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।”
সুশীল কিন্তু প্রস্তাবটায় রীতিমতো আগ্রহী হয়ে উঠল। প্রদীপকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আগে প্রস্তাবটা তো শুনি।”
আমি বললাম, “বিপাশা এখন ক-দিন আর ফোন ধরবে না। ফোন এলে অমলই ধরবে। ওই দুষ্কৃতীর ফোন এলে অমল মাইকেলের ‘মেঘনাদ বধ’ কিংবা মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ থেকে নন-স্টপ পড়ে যাবে। ও যেন কথা বলার কোনও সুযোগই না পায়।”
এরপর চারজনে সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করা হল, প্রথমে প্রদীপের প্রস্তাব মতো এগুনো হবে। তাতে কাজ না হলে মাইকেল মধুসূদন কিংবা জন মিলটনের শরণ নেওয়া হবে। তাতেও কাজ না হলে, সব শেষে সুশীলের দমদম দাওয়াই প্রয়োগ করা হবে।
সুশীল এর সঙ্গে জুড়ে দিল, “প্রথম বা দ্বিতীয় প্রস্তাবে সমস্যা মিটে গেলেও, অমলের বাড়িতে লুচি, মাংস খেতে যাওয়া হবে।”
পরদিনই প্রদীপ ওর চেনা পুলিশ অফিসারকে জানাল ব্যাপারটা। সব শুনে উনি বললেন, “চিন্তার কিছু নেই। এক মাসের মধ্যে কালপ্রিটকে টাইট দিয়ে দেব।”
দিন দশেক যাওয়ার পরে, অমল একটু হতাশ হয়ে পড়ল। তখনো ওই ফোনটা আসছে। ও বলল, “উনি কি আদৌ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন?”
প্রদীপ আবারো ওনার সঙ্গে কথা বলে জানাল, এক একদিন এক এক এলাকার টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করছে। আজ সল্টলেক তো কাল শিয়ালদার বুথ থেকে। পরের দিন নাগেরবাজার তো তার পরের দিন শ্যামবাজাজের বুথ থেকে ফোন করছে। ফলে একটু সময় লাগবে। তবে এক মাসের মধ্যে ধরা পড়বেই।
প্রদীপ, সুশীল ও আমার ভদ্রলোকের কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও, অমলের অস্থিরতা কমে না। তাই ঠিক হল, এক মাস অপেক্ষা না করেই আমার প্রস্তাবটা কাজে লাগানো হবে। পুলিশের কাজ পুলিশ করুক– কালপ্রিট ধরা পড়লে তো জানাই যাবে। সাইমালটেনিয়াসলি, অমল মাইকেল কিংবা মিলটন নিয়ে মাঠে নেমে পড়ুক।
অমল বলল, ওদের বাড়িতে ‘মেঘনাদ বধ’ থাকলেও, মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ নেই। অন্যদিকে, ও বরাবর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে বলে, ‘মেঘনাদ বধ’-এর চাইতে ‘প্যারাডাইস লস্ট’-ই ওর বেশি পছন্দ।
অগত্যা, সুশীলের পরামর্শে ঠিক হল, আমি অমলকে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ সরবরাহ করব।
পরের দিনই আমি অমলকে মিলটনের ওই বইটা পাঠিয়ে দিলাম। এরপর শুরু হল ফোনে অমলের মিলটনের মহাকাব্য পাঠ। দুষ্কৃতীটা ফোন করলেই অমল ওর হেঁড়ে গলায় ওকে নন-স্টপ ‘প্যারাডাইস লস্ট’ শোনাতে লাগল! কিমাশ্চর্যঅতঃপরম্। ক-দিন বাদে প্রফুল্ল চিত্তে অমল আমাদের জানাল, “ওই ফোনটা আর আসছে না!”
তাহলে কি কালপ্রিট পুলিশের জালে ধরা পড়েছে! প্রদীপ খবর নিয়ে জানাল, না তখনো ধরা পড়েনি।
তখন সবাই মিলে সাব্যস্ত করা গেল, অমলের নন-স্টপ মিলটনেই কাজ হয়েছে। সুশীল বলল, “এমনি এমনি কি আর গিরিশ ঘোষ আওড়াই! আর একবার প্রমাণ হয়ে গেল, কবিরা মোস্ট পাওয়ারফুল।”
আমারও যারপরনাই আনন্দ হল! আমার আনন্দের প্রথম কারণ, অমলের সমস্যাটা মিটে গেছে। দ্বিতীয় কারণ, আমার প্রস্তাব এফেক্টিভ প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয় কারণ, আমি একটু আধটু কবিতা লিখি। ফলে, মহাকবি মিলটনের সাফল্যে, কবি হিসেবে আমার তো একটু বাড়তি আনন্দ হবেই।
সুশীল কালবিলম্ব না করে ওর লুচি, মাংসের প্রস্তাবটা মনে করিয়ে দিল।
পরের শনিবার সন্ধেবেলা, কে সি দাসের পরিবর্তে, অমলদের টালিগঞ্জের বাড়িতে গ্যাং অফ ফোরের অধিবেশন বসল। সেই অধিবেশনে মিলটনের জয়ধ্বনি করতে করতে প্রচুর পরিমাণ লুচি, মাংসের সদ্ব্যবহার করে যে যার বাড়ি ফিরে এলাম।
অসাধারণ ভারী চমৎকার লাগলো গল্পটা
অনেক ধন্যবাদ। শুভেছা অবিরত।
বা: বেশ ভাল মিলটনি দাওয়াই
কবিতার ক্ষমতার সীমা নাই।
একদম ঠিক! সেই জন্যই তো সেই ছোটবেলাতেই আমি মহাকবি বাল্মীকিকে ধরেছি। একটু বড়ো হয়ে ধরেছি আর এক মহাকবি রবীন্দ্রনাথকে। ধরেছি যখন, আর ছাড়ছি না।