লিমেরিকের টুকিটাকি

লিমেরিক হল পাঁচ লাইনের ছড়া। প্রবাসী পত্রিকায় ভাদ্র, ১৩৩৬ সংখ্যায় লেখা হয়, “ইংরেজীর একটি চুটকী ছন্দ Limerick নামে প্রসিদ্ধ; বিগত শতকের মধ্যভাগ হইতে ছোটোখাটো রসিকতা বা ব্যঙ্গের কবিতায় পাঁচ লাইনের প্যারাগ্রাফময় এই পদ্যবন্ধটি ইংরেজীতে খুবই ব্যবহৃত হইতেছে।” লিমেরিকের উৎপত্তি নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। তবে এটা বলা হয় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর আইরিশ সৈনিকদের একটা কোরাস গান “Will You Come Up to Ireland” থেকে লিমেরিক নামটির উদ্ভব। ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ডে লিমেরিক সংগ্রহের হদিশ পাওয়া যায়। এডওয়ার্ড লিয়ার ১৮৪৬ সালে তাঁর ‘Book of Nonsense” প্রকাশ করার পর লিমেরিক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এডওয়ার্ড লিয়ারের দাবী অনুযায়ী তিনি একটা নার্সারি ছড়া “There was an old man of Tobago” থেকে লিমেরিকের ধারণা পেয়েছিলেন।

এডওয়ার্ড লিয়ারের নীচের ইংরেজি লিমেরিক ও তার বাংলা অনুবাদটি লক্ষ্য করা যাক।

There was an Old Person of Dean,
Who dined on one pea and one bean;
    For he said, "More than that 
    Would make me too fat,"
That cautious Old Person of Dean. 
দাঁতনবাসী এই বুড়োটার নামটি প্রতুল জানা,
ডিনার খেত একখানা বিন একটা মটর দানা।
    স্বল্পাহারের কারণটা তার সোজা,
   "এর বেশিতে জমবে মেদের বোঝা;"
স্বাস্থ্যচেতন এই বুড়োটার বেশি আহার মানা।
এডওয়ার্ড লিয়ার, যাঁকে লিমেরিকের প্রকৃত জন্মদাতা বলা জেতে পারে।
এডওয়ার্ড লিয়ার

লিমেরিকের প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের অন্ত্যমিল থাকে। তৃতীয় লাইনের সঙ্গে অন্ত্যমিল থাকে চতুর্থ লাইনের। পঞ্চম লাইনটি দ্বিতীয় লাইনের সঙ্গে অন্ত্যমিল রক্ষা করে। প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম লাইন তিনটি আকারে সমান ও তৃতীয় এবং চতুর্থ লাইনের চাইতে বেশি লম্বা হয়। অপেক্ষাকৃত ছোটো তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন দুটো মাঝখানে ঢোকানো অবস্থায় থাকে।

ওপরের লিমেরিকের বাংলা অনুবাদটিতে বাংলা  নামধাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ওটির যথাসম্ভব বঙ্গীকরণ করা হয়েছে। নীচে লিয়ারের আর একটা লিমেরিক ও তার বাংলা অনুবাদ দেওয়া হল।

There was an Old Man with a beard,
Who said, 'It is just as I feared!--
         Two Owls and a Hen,
         Four Larks and a Wren,
Have all built their nests in my beard!'
There was an Old Man with a beard
দাড়ি-বুড়ো বলল কেশে কেশে,
'আশঙ্কাটা সত্যি হল শেষে!--
  চারটে শালিক, যুগল পেঁচা,
  একলা মোরগ, হাঁড়িচাঁচা 
দাড়ির মধ্যে বাঁধল বাসা এসে!'

অনেকদিন ধরে বাঙালি কবিরা লিমেরিক লিখে চলেছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রথমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি লিমেরিকের উল্লেখ করছি।

মন উড়ু উড়ু, চোখ ঢুলু ঢুলু, ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক--
আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো, ছন্দটা নিরবাঁধুনিক।
       পাঠকেরা বলে, 'এ তো নয় সোজা,
       বুঝি কি বুঝি নে যায় না সে বোঝা।'
কবি বলে, 'তার কারণ, আমার কবিতার ছাঁদ আধুনিক।'

পরের লিমেরিকটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের।

আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি, তুমি leisure মাফিক বাসিও।
আমি নিশিদিন রেঁধে বসিয়ে আছি, তুমি যখন হয় খেতে আসিও।
         আমি সারাদিন তব লাগিয়া 
         রব চটিয়া-মটিয়া রাগিয়া,
তুমি নিমেষের তরে প্রভাতে এসে দাঁত বের করে হাসিয়ো।

এর পরে গুরুসদয় দত্তের লেখা একটি লিমেরিক।

ছিলেন এক আরামবাগের আমলা,
হত যখন কোনো মামলা,
   দিয়ে দুই পক্ষকেই আশা
   করতেন আমদানিটি খাসা,
আরামবাগের অমায়িক সেই আমলা।

নীচের লিমেরিকটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের।

রেগে আগুন চণ্ডীখুড়ো, ছিঁড়ছে নিজের দাড়ি--
গিন্নি এসে মাথায় তাহার চাপায় ভাতের হাঁড়ি।
       খুড়ো যতই চেঁচিয়ে ওঠে,
       খুড়ীর মুখে হাস্য ফোটে,
চটবে যত ভাতটা তত ফুটবে তাড়াতাড়ি।

এবারে সত্যজিৎ রায়ের একটি লিমেরিক।

রাম ফাঁকিবাজ চাকর জোটে সাধনবাবুর ভাগ্যে,
বাবু বলেন, 'রোবট রাখি, চাকরগুলো যাক গে।'
    রোবট হল কাজে বহাল 
    তার ফলে আজ বাবুর কী হাল?
রোবট বলে, 'কই রে ব্যাটা!' বাবু বলেন, 'আজ্ঞে?'

এডওয়ার্ড লিয়ারকে নিয়েও বাংলা ভাষায় লিমেরিক লেখা হয়েছে।

এডওয়ার্ড লিয়ার 
করেন না 'ফিয়ার'
  বাঘ ধরেন
  সিংহ ধরেন
ধরেন না 'ডিয়ার'।*

বাঘ, সিংহ, পশুপাখি নিয়ে যেমন লিমেরিক লেখা হয়েছে, তেমনই মশা-মাছিকে নিয়েও লিমেরিক লেখা হয়েছে। নীচে এরকম একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া হল।

হাওড়া থেকে রাঁচি 
উড়ে বেড়ায় মাছি;
  দলে দলে 
  মশা বলে, 
"আমরাও স্যার আছি!"*
অলঙ্করণ : মৃণাল শীল

এডওয়ার্ড লিয়ারের অনেক ইংরেজি লিমেরিক বাংলায় অনুদিত হয়েছে। এডওয়ার্ড লিয়ারের পাশাপাশি লুইস ক্যারল, টমাস এনস্টে গুথরে, রুড ইয়ার্ড কিপলিং, আর্নল্ড বেনেট, বারট্রান্ড রাসেল ও আরো অনেক বিখ্যাত লেখকের ইংরেজি লিমেরিকও বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। রাসেলের একটি  ইংরেজি লিমেরিক ও তার বাংলা অনুবাদ নীচে দেওয়া হল।

There was a Young  Girl of Shanghai, 
Who was so exceedingly shy, 
   That undressing at night 
   She turned out the light 
For fear of All-Seeing Eye.
সাংহাইয়ে ছিল এক যুবতি,
স্বভাবে সে ছিল খুব লাজুকি, 
  রাত্তিরে খুলে তার বস্ত্র 
  আলো 'অফ্' করে দেয় ত্রস্ত, 
'গড্' যদি দেখে ফেলে 'ভিউ'-টি,

লিমেরিক বললে ননসেন্স রাইমের কথা মনে আসে। এডওয়ার্ড লিয়ারের লিমেরিক ননসেন্স রাইম হিসেবে বিখ্যাত। অবশ্য, অনেক বাংলা লিমেরিক যথেষ্ট অর্থবান। শৈলেনকুমার দত্তের নীচের লিমেরিকটি লক্ষ্য করা যাক।

প্যাংলা নামে ডাকত লোকে, এখন 'বাবু বরেন' --
ব্যস্ত ভাবে সারাটা দিন দেশের কাজই করেন ।
      পাঁচ বছরে তিনটে বাড়ি,
      ব্যাঙ্কে টাকা, তেমনি গাড়ি --
' কী করে হয়?' বলতে গেলেই জামার কলার ধরেন !

কিংবা আর এক ছড়াকারের নীচের  লিমেরিকটি–

আমাদের হাতে আর নেই কিছু কার্য
চলো যাই তাড়াতাড়ি গড়ি সাম্রাজ্য;
       জিনিসের দাম বাড়ে 
       টের পাই হাড়ে-হাড়ে,
বেকারের সংখ্যাটা কোটিতে বিভাজ্য!*

বাংলা ভাষায় লিমেরিকের ভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। অসংখ্য কবি ও ছড়াকার লিমেরিকের ভাণ্ডারকে প্রতিদিন সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আশা করা যায়, আগামী দিনে বাংলা লিমেরিকের ধারা আরো বেশি বেগবান হবে। 

(ইংরেজি লিমেরিকগুলির বাংলা অনুবাদ ও *চিহ্নিত লিমেরিকগুলি এই লেখকের।)

কবি লিপিকা সেন সরকারের লিমেরিক লিখতে চাওয়ার আগ্রহ থেকে এই লেখা তৈরি হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *