কবি ভবতোষ শতপথী

কবি ভবতোষ শতপথী পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। এখন আঞ্চলিক ভাষায় অনেকেই কবিতা লিখছেন। আঞ্চলিক ভাষার কবিতার পাঠক ও শ্রোতাও এখন দুর্লভ নন। কিন্তু ভবতোষদা যখন আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন আঞ্চলিক ভাষার কবিতার লোকমান্যতা বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। সেদিক থেকে ভবতোষদা পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা কবিতার ভগীরথ।

কবি ভবতোষ শতপথী
কবি ভবতোষ শতপথী

অন্যদিকে, প্রমিত বাংলা ভাষার ওপর ভবতোষদার অসাধারণ দখল ছিল। বাংলা ছন্দকে অনায়াস দক্ষতায় কবিতায় ব্যবহার করতেন। প্রমিত বাংলায় তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের অসংখ্য কবিতা লিখেছেন।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার টুলিবড় গ্রামে ১৯৩৫ সালে এই কবির জন্ম। তিনি ছিলেন ওই গ্রামের অবস্থাপন্ন সচ্ছল বাসিন্দা পতিচরণ শতপথীর একমাত্র পুত্র। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। পরে বিহারের বহড়াগোড়া স্কুল ও ঝাড়গ্রামের বিখ্যাত কুমুদকুমারী স্কুলে লেখাপড়া করেন। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনও দুর্বলতা ছিল না। ফলে, তিনি আর কলেজমুখো হওয়ার আগ্রহ দেখাননি।

একদিকে জমিদারির উত্তরাধিকারে বঞ্চনার শিকার হয়ে, অন্যদিকে স্ত্রীর অকালপ্রয়াণে তিনি একেবারে অথৈ জলে পড়ে যান। তিন সন্তান নিয়ে অকূলপাথারে ভাসতে ভাসতে নিঃস্ব এই মানুষটি কবিতা ও দরিদ্র সাধারণ মানুষকে জীবনের  অবলম্বন করে নেন। ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ভবতোষ শতপথীর প্রয়াণ ঘটে

বোহেমিয়ান স্বভাবের কবির সংসারে মন বসেনি। ফলে তাঁর পারিবারিক জীবন আনন্দের হয়নি। অর্থকষ্টে জেরবার সংসার কোনও রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলের প্রতি কর্তব্যপালনে অপারগতা তাঁকে আত্মীয়স্বজনদের কাছে অপ্রিয় করেছে। কবি তাতে কর্ণপাত না করে সমাজের দলিত মানুষদের সঙ্গে মিশে থেকে তাঁদের দারিদ্রপীড়িত ও লাঞ্ছিত জীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কবিতা ও গানের রসদ। সুবর্ণরেখা ও ডুলুং নদী, ঝাড়গ্রাম মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বন-জঙ্গল, প্রান্তর, পাহাড় ও টিলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিভোর কবি সংসার করলেও আর পাঁচজনের মতো ঠিকঠাক সংসারী হয়ে উঠতে পারেননি।

তাঁর গুণগ্রাহীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে অল্পস্বল্প আর্থিক সাহায্য করলেও অভাবঅনটন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অভাবঅনশনক্লিষ্ট কবিকে কোনো অনুষ্ঠানে মালা ও পুষ্পস্তবক দিলে বলতেন, মালা ও উপহার সামগ্রীর পরিবর্তে কিছু টাকা দিলে তিনি ও তাঁর বাড়ির লোকজন দু-চারদিন পেট ভরে খেতে পারবেন। কী মর্মান্তিক অভাবের ভিতর দিয়ে গেলে তাঁর মতো একজন আপোসহীন কবি এরকম কথা বলতে পারেন!

১৯৯২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে দুঃস্থ কবি হিসেবে সামান্য মাসিক ভাতা পেতেন কবি। ২০১২ সালে কী এক কারণে তাঁর এই ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, তাঁর অর্থকষ্ট আরো বেড়ে যায়। জীবদ্দশায় তিনি আর কোনও দিন রাজ্য সরকারের ওই ভাতা পাননি।

পশ্চিমবাংলার  মেদিনীপুর/ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী বিহার/ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যার প্রান্তিক মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর নিয়ত আত্মিক যোগাযোগ তাঁকে ব্যস্ত রেখেছিল ঝাড়গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা কুড়মালি ভাষায় অসংখ্য কবিতা ও গান রচনায়। তাঁর লেখা ঝুমুর গান ঝুমুরগানের বিখ্যাত শিল্পী বিজয় মাহাত-র কণ্ঠে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নৃত্যনাট্য ‘চণ্ডালিকা’ কুড়মালিতে অনুবাদ করেন। কুড়মালি ভাষায় তাঁর অনূদিত ‘চণ্ডালিকা’ ১৯৯৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে পরিবেশিত হলে খুব সমাদর লাভ করেছিল। দুঃখের বিষয়, তিনি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কুড়মালি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করলেও, শেষ করে যেতে পারেননি।

তাঁর ‘অরণ্যের কাব্য’ প্রকাশিত হওয়ার পরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কলকাতার ‘বর্তমান’ পত্রিকা লিখেছিল, “ভবতোষ শতপথীর প্রথম কাব্য সংকলন ‘অরণ্যের কাব্য’। বাংলা কবিতার মর্মধারায় কবি এক মোচড় দিয়ে মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে গেছেন অরণ্য মনের গভীর  গোপনে। …..অরণ্যের কাব্য আর্য ব্রাহ্মণ্যের আত্ম পিণ্ডদান— “ব্রাহ্মণের পৈতা ছিঁড়ে হাহাকারে হয়েছি চণ্ডাল” “…দ্বিজ নই আমি ত্রিজ”…..”নমস্কার করে আমি নমঃশূদ্র হয়ে গেছি।”—এখানেই কবির পূর্বাশ্রমের বিলুপ্তির ইতিকথা এবং বন্যাশ্রমে বিলীনের ইতিহাস। …..বাংলা সাহিত্যে ‘অরণ্যের কাব্য’ অপূর্ব অদ্ভুত স্বাদে গন্ধে চরিত্রে।”

অরণ্যের কাব্য ও সংকলিত ভবতোষ

সন্নিহিত তিন রাজ্যের প্রায় চার কোটি মানুষের ভাষায় ভবতোষবাবুর কাব্য এক আত্মিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগের রূপ নিচ্ছে। ‘অরণ্যের কাব্য’  এক মহান সৃষ্টি।”

কবির ‘অরণ্যের কাব্য’ থেকে কয়েকটা নির্বাচিত পঙ্ক্তি নীচে তুলে দেওয়া হল।

স্বাধীন ভারতবর্ষ পণ্ডিত-মূর্খের নিজদেশ 
মানুষ-নিসর্গ-মাটি মনে আনে জন্মের আবেশ 
মানব-জাতির প্রতি প্রেম-প্রীতি গভীর বিশ্বাস 
মানুষ না হলে, কোনো লাভ নেই, হয়ে "জিনিয়াস"।
#
জীবিত কবরে বাস অগণিত বিবর-নিবাসী 
সংকীর্ণ বস্তির বুকে অপুষ্টিজনিত অষ্টাদশী 
অস্পষ্ট যৌবন-চিহ্ণ ক্ষীণ দেহ অস্থিচর্মসার 
নাই পীন-পয়োধর মাতৃত্বের অমৃত পয়ার।
#
সেয়ানে সেয়ানে চলে কোলাকুলি, ভাববিনিময় 
বাগে পেলে অনুরাগ, বীতরাগে পরিণত হয় 
স্বার্থপর মেলামেশা এক বুক আত্মকেন্দ্রিকতা 
আত্মসুখী অভাজন, মহামান্য নির্বাচিত নেতা।
#
মুখে মধু অন্তরে বিষ স্বার্থপরতার ভালোবাসা
দুর্দশা দর্শন হেতু ছদ্মবেশে করে যাওয়া-আসা 
মিল নেই মানুষের মুখের ও বুকের ভাষায় 
আপাতত আপন যে, পরক্ষণে পর হয়ে যায়।
#
হায় রে দাম্ভিক কবি, কবিতা কৈবল্য অহংকার 
তীক্ষ্ণ শ্লেষ ছিন্ন বেশ অভাবের অচল সংসার 
মিথ্যা খ্যাতি নাম-যশ প্রায় দিন শূন্য পাকস্থলী 
ইহকালে দাবদাহ, পরকালে পাবে করতালি।
#
গতকাল যে লোকটা ভাবে গদগদ কথা বলে 
আজ কেন সে এখন আমাকে এড়িয়ে যায় চলে 
পরনিন্দা পরচর্চা ইতর ভদ্রের ইশারায় 
আপন ও প্রিয়জন পর হয়ে যায়।
#
কলুষিত পরিবেশ দালাল-শোভিত সারা দেশ 
মানুষের চেয়ে বেশি মূল্যবান ছাগ কিংবা মেষ
পশুকুলে বংশবৃদ্ধি বর্তমানে আশু প্রয়োজন 
হায়রে মানবশিশু, তোর ভাগ্যে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ।

‘অরণ্যের কাব্য’ প্রকাশের আগে তিনি তিরিশ বছর ধরে কবিতা লিখেছেন। ভাবলে অবাক হতে হয়, তিরিশ বছর কবিতা লেখার পরে তাঁর মতো শক্তিশালী কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল।

আসলে ভবতোষদা ছিলেন, একেবারে প্রচারবিমুখ মানুষ। কোথাও কবিতা বেরোল কিনা, কে কী বললেন তাঁর কবিতার ব্যাপারে– তা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তিনি লিখেই খালাস! প্রকাশিত কবিতার সংরক্ষণেও তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। ফলে বিস্তর ক্ষতি হয়েছে। তাঁর অনেক কবিতাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে! 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ভবতোষদার সংগ্রহে তাঁর কোনও কবিতার বই ছিল না। কলকাতার একটি লিটল ম্যাগাজিন এক সময় ওই পত্রিকার এক একটা সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার এক একজন কবিকে নিয়ে ‘কবিতার পথে পথে’ শিরোনামে লেখা প্রকাশ করছিল। স্কিমটা ছিল এই রকম। কেউ একজন কবির সঙ্গে কথা বলে তাঁর জীবন ও কাব্যকৃতি নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবেন। প্রবন্ধের পরে কবির নিজের বেছে দেওয়া তাঁর প্রতিনিধিস্থানীয় দশটা কবিতা ছাপা হবে। ২০১২ সালে ভবতোষদার ওপর লেখার দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ভবতোষদার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘণ্টা চারেক কথা বলে দু-তিন দিনের মধ্যে লেখাটা লিখে ফেললাম। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁর কবিতা নিয়ে। ভবতোষদার কাছে তাঁর কোনও কবিতার বই নেই। তাই, হাতের কাছে যা পেলেন তাই জেরক্স করে দশটা কবিতা দিলেন। তা দেখে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর মাথায় হাত। প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা তো দূরের কথা, তাঁদের জানা ভবতোষদার কোনও কবিতাই তাতে নেই! অগত্যা, ‘অরণ্যের কাব্য ও সংকলিত ভবতোষ’ থেকে কবিতা বাছাই করে কাজ সারতে হয়েছিল।

ভবতোষদার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অল্প একটু অংশ নীচে তুলে দেওয়া হল।

প্রশ্ন: কোন বয়সে আপনার কবিতা লেখার শুরু?

উত্তর: ষোলো বছর বয়সে প্রথম কবিতা লিখি।

প্রশ্ন: মনে আছে কবিতাটা?

উত্তর: হ্যাঁ, মনে আছে। (স্মৃতি থেকে বলতেন শুরু করলেন)।

আড়াল থেকে আমায় দেখে মুচকি হাসি হাসলে
মনে হল এবার বুঝি সত্যি ভালোবাসলে।
তুমি তখন দাঁড়িয়ে ছিলে বকুলগাছের তলায় 
চিকন কালো ব্যাকুল বেণি বাতাস লেগে উড়ছিল 
রামধনু রঙ ভাবনাগুলো ছড়িয়ে ছিল হাওয়ায়
অবুঝ এ মন ধীরে ধীরে তোমার কাছে ভিড়ছিল।
রাতজাগা ঘুম ভাঙল সেদিন শীতের সকাল আটটাতে 
এসেছিলে হয়তো তুমি চাওয়াপাওয়ার মাঝরাতে।

প্রশ্ন: আপনার ছন্দের গুরু কে?

উওর: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ কতটা পড়েছেন?

উত্তর: কিছুটা পড়েছি।

প্রশ্ন: জীবনানন্দ দাশ?

উত্তর: ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেন’।

প্রশ্ন: সুকান্ত ভট্টাচার্য?

উত্তর: সুকান্ত পড়তে পড়তে প্রেমপ্রীতি নিয়ে বিতৃষ্ণা তৈরি হয়ে গেছে। 

প্রশ্ন: সুকান্ত আপনার প্রিয় কবি?

উত্তর: সুকান্ত, নজরুল।

প্রশ্ন: আর কোন কোন কবি আপনার প্রিয়?

উত্তর: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণিভূষণ ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন: সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে?

উত্তর: গভীরের কবি। বোঝা যায় না।

প্রশ্ন: শক্তি চট্টোপাধ্যায়?

উত্তর: শক্তিমান কবি।

প্রশ্ন: এই সময় সম্পর্কে কী মনে হয়?

উত্তর: এই অশান্তি বিচ্ছিন্ন করছে মানুষকে।

প্রশ্ন: নিজের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?

উত্তর: আমি তো আঁতেল নই । আমি ছোটোজাতের কবি। আমি চুয়াড়দের কবি।

এখন ভবতোষদার দু-একটা কবিতার উল্লেখ করব। প্রথমে প্রমিত বাংলায় লেখা একটি কবিতা।

বেশ করেছি

বেশ করেছি, সব বেচেছি
বাঁচার তাগিদে।
শেষ সম্বল ভালোবাসা,
বেচবো নগদে।

টিপ দিয়েছি, সই করেছি
দু'পিঠ দলিলে 
জানিয়ে সেলাম, সামিল হলাম 
মস্ত মিছিলে।

সুখের মুখে ছাই দিয়েছি
দুঃখের দায় ভাগ;
এই জীবনের প্রতি আমার 
অন্য অনুরাগ;

চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, 
আমার তাতে কি?
শূন্য ঘরে অন্ধকারে--
একলা বসেছি।

একবার পড়েই পাঠক বুঝতে পারবেন, এই কবির কলমের জোর। একইভাবে, নীচের কবিতাটিতে তাঁর কলমের সামর্থ যেন উপড়ে পড়েছে।

বাক-প্রতিমা 

শব্দ শৃংগার 
ভাবের ভৃংগার 
বীণার ঝংকার 
           ঝংকৃত।

শুভ্র সুষমায় 
শিল্প চেতনায় 
বিশ্ব চরাচর 
            চিত্রিত।

কাকলি কলতান 
ভাসানে ভাসমান 
বেদনা বেদগান 
           মূর্ছনা।

আহত দুই তীর 
সতত অস্থির 
মৌন মুখরিত 
         ব্যঞ্জনা।

দীর্ঘ কেশপাশ 
কবরী বিন্যাস 
কবি কি ক্রীতদাস 
            বঞ্চিত। 

লুপ্ত তপোবন 
সুপ্ত ত্রিভুবন 
কামিনী কাঞ্চন 
            সঞ্চিত। 

স্তনিত দেহভার 
সুরেলা শীৎকার 
অশুভ অভিসার 
             স্তম্ভিত।

অসুখী শয্যায় 
প্রহর কেটে যায় 
মানুষ অসহায় 
             বিব্রত।

এবার তাঁর একটা আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় লেখা কবিতার উল্লেখ করব।

নামঅ পাড়ার ছঢ়া*

হাড়াম বুঢ়ি গবর কুঢ়ায়
লদী পারের টাঁইড়ে
থুথ্মা ডাঁগায় কপতি গগায়
কাঁটা বাঁশের ঝাঢ়ে।

ইড়ক্যেঁ বুলে আড়্যাঁ বাছ্যুর 
ভেভায় ছাগ্যল ছানা
ভুগহা-পিঁধা মকরা লধা
টাইনছে ছিঁড়া টেনা।

কুঁড়চি বুদায় ফুল ফুট্যেঁছে
আচকা মহ্যক আসে
ছটকি বহু ছইটক্যেঁ উঠে
বড়কি যেখ্যন হাসে।

ছাথি ফুলায়ঁ কুলহি বুলে
বোড়োলোকের বিটি
ঢইনক্যেঁ মইরছে খালে বিলে 
নামঅ পাড়ার পুঁটি।।

“শিরি চুনারাম মাঁহত” কাব্যগ্রন্থের ‘শিরি চুনারাম মাঁহত’ তাঁর লেখা আঞ্চলিক কুড়মালি  ভাষায় লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। দীর্ঘ এই কবিতায় দরিদ্র চুনারামের দারিদ্র, দুঃখ, যন্ত্রণা ও হতাশাকে তাঁর অনুপম ও অননুকরণীয় কাব্যশৈলীতে প্রকাশ করেছেন। কালজয়ী এই কবিতার দুটো অবিস্মরণীয় লাইন– ‘ভালবাসা ভেস্তায়ঁ গেলে–/ যার বাপ হবার কথা– সে মামা হয়্যেঁ যায়!’

‘অরণ্যের কাব্য’, ‘জল পড়ছে’, ‘ঢেমনা মঙ্গল’, ‘শিরি চুনারাম মাঁহত’, ‘জুমঢ়া’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের জন্য এই কবি অমর হয়ে থাকবেন।

বোবার শত্রু না থাকলেও, কবির শত্রুর অভাব হয় না। ভবতোষদার মতো ভোলেভালা মানুষেরও শত্রু ছিল। আর থাকবে নাই বা কেন! এ প্রসঙ্গে আজিজুল হকের লেখা থেকে একটু তুলে দেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ….’ এক জায়গায় এসে চোখটা আটকে গেল –“তীক্ষ্ণ পাটন, করে টনটন, নগ্ন টাঙ্গির ধার, প্রতিশোধ নিতে, পশুবলি দিতে, উদ্যত হাতিয়ার।”

আরে! এটা যেন কোথায় পড়েছি! বেশি কষ্ট করতে হল না– মনে পড়ে গেল।

“অস্ত্র ধরেছি, এবার সম্মুখে শত্রু চাই।”

 সুকান্ত-কবি শত্রুর খোঁজে অস্ত্র ধরেছিলেন, আর ইনি তো শত্রু পেয়েই গেছেন। পাবেনই তো। বাপের বাউণ্ডুলে ছেলে। জমিদার-নন্দন। ফেরেপবাজিতে পড়ে, সব বেচে বুচে এখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখেছেন। সুতরাং ইনি হাড়ে হাড়ে জানেন শত্রু কারা।’

ভবতোষদা ছিলেন, ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক।’ যতই ভোলেভালা হন, যতই সর্বক্ষণ আবেগে টইটম্বুর থাকুন, কলম হাতে নিয়ে তিনি কখনোই তাল হারাননি। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের পক্ষে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অগ্নি উদগিরণ করতে তাঁর কলম কখনোই থেমে থাকেনি। আজিজুল হক যথার্থই লিখেছেন, “….ভবতোষ-কবি তাই ‘অরণ্যের কবি’ নন, অরণ্যবাসীদের সংগ্রামের কবি।”

কবির জীবদ্দশাতেই তাঁর কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁকে নিয়ে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে।

একটা সময় পর্যন্ত কবির কবিতার বই খুব সহজে পাওয়া যেত না। এখন ঝাড়গ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘অরণ্যের কাব্য ও সংকলিত ভবতোষ’ পাওয়া যায়। এতে কবির ছ-টা কাব্যগ্রন্থের কবিতা সংকলিত হয়েছে। কিছুদিন হল ঝাড়গ্রামে ‘কবি ভবতোষ স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়েছে। এই কমিটির সদস্যরা কবির লেখা সমস্ত কবিতা ও গান ‘ভবতোষ রচনা সমগ্র’ নামে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছেন। ইতিমধ্যে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ চলছে। কবির অনেক রচনা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। এখনও যতটা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার সবটাকে রক্ষা করা গেলে একটা ভালো কাজ হবে।

ভবতোষ রচনা সমগ্র ১

*নামঅ– নামো, নীচের দিকের। 

ছঢ়া– ছড়া।

নামঅ পাড়ার ছড়া– নামো পাড়ার ছড়া।

হাড়াম– বৃদ্ধ।

বুঢ়ি– বুড়ি।

হাড়াম বুঢ়ি — বৃদ্ধা বুড়ি

গবর– গোবর।

কুঢ়ায়– কুড়ায়।

লদী– নদী।

টাঁইড়ে– টাঁড়ে

থুথমা– অনুর্বর ও উঁচু।

ডাঁগা– ডাঙা।

কপতি — ঘুঘু  (কপোতী থেকে এসেছে। কপোতী মানে স্ত্রী পায়রা বোঝায়। কপতি স্ত্রী ও পুরুষ ঘুঘু উভয়কেই বোঝায়)।

গগায় — (চিৎকার করে) ডাকে ।

ঝাঢ়ে– ঝাড়ে।

ইড়ক্যেঁ — দৌড়ে।

বুলে– বেড়ায়।

আঁড়্যা– এঁড়ে।

বাছ্যুর– বাছুর।

ভেভায়– জোরে চেঁচায়।

ছাগ্যল– ছাগল।

ভুগহা-পিঁধা– ত্যানা পরা 

(ভুগহা– এক টুকরো কাপড় যা শুধু লজ্জাস্থান টুকু ঢাকে।

পিঁধা– পরা)।

মকরা– ব্যক্তির নাম (মকর)।

লধা– লোধা।

টাইনছে — টানছে।

ছিঁড়া– ছেঁড়া।

টেনা– ত্যানা কাপড়। (একটু  আগে যাকে ভুগহা বলা হল। টানছে, কারণ তা এতই ছোটো যে স্থানচ্যুত হয়ে পড়ছে। টানছে লজ্জাস্থান ঢাকতে)।

কুড়চি- এক রকম গাছ।

বুদায়– ঝোপে।

আচকা- হঠাৎ।

মহ্যক– গন্ধ।

ছটকি বহু- ছোটো বউ (কোনো বাড়ির ছোটো ছেলের স্ত্রী)।

ছইটক্যাঁ– দ্রুত স্থানত্যাগে উদোগী হয়ে ছটফট করে।

উঠে– ওঠে।

বডকি– বড়ো বউ (কোনো বাড়ির বড়ো ছেলের স্ত্রী)।

যেখ্যন– যখন। 

হাসে– হাসে,

ছাথি– ছাতি।

ফুলায়ঁ– ফুলিয়ে।

কুলহি — কুলি (গ্রামের পাড়ার রাস্তা, যার দুপাশে বাড়ি থাকে)।

বুলে– বেড়ায়।

(কুলহি বেঢ়ায়– গ্রামের পাড়ার রাস্তায় বা কুলিতে ঘুরে বেড়ায়)।

বোড়োলোকের– অবস্থাপন্ন লোকের।

বিটি– মেয়ে।

ঢইনক্যেঁ– ধুঁকে।

মইরছে– মরছে।

নামঅ– নীচের বা তলার  দিকের (নামো)।

নামঅ পাড়া– নীচের বা তলার দিকের পাড়া (নামো পাড়া)।

পুঁটি– অল্পবয়সী মেয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *