জীবন অনেক দামি

এই ক-মাসে করোনা নিয়ে একটা কবিতার ওয়েবসাইটে আমার লেখা ছড়াগুলোকে পরপর রেখে ভাবছিলাম, ছড়াগুলির মাধ্যমে পাঠকদের কাছে কী বক্তব্য পৌঁছাল। এই লেখায় সেটাই খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।

গোটা ভারতবর্ষে তখন করোনার জন্য লকডাউন চলছে। পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজে তার আগেই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে চালু হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। সব মিলিয়ে এক থমথমে পরিবেশ। এই পরিস্থিতিতে ছাব্বিশে মার্চ করোনা নিয়ে একটা লিমেরিক লিখি। লিমেরিকটা এরকম।

দুইয়ে দুইয়ে চার বুঝি সর্বদা হয় না,
মানুষের সুখ দেখে পোকাদের সয় না!
        করোনার উৎপাতে 
        খাই শুধু আলু-ভাতে;
ভয়ে ভয়ে ঘরে আর সময় এগোয় না!
করোনা
প্রতীকী ছবি

টোটাল লকডাউনের জন্য গাড়িঘোড়া বন্ধ তো বটেই, পাস ছাড়া পায়ে চলাচলও তখন নিষেধ। এরই মধ্যে সবার নজর এড়িয়ে বিনা পাসে কেউ এসে পড়লে গৃহস্থ বিপন্ন বোধ করেন! যা হোক করে, খাইয়েদাইয়ে তাঁকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াই তখন বুদ্ধিমানের কাজ। অবশ্য, অতিথির তরফেও ফিরে যাওয়ার ব্যস্ততা। ঊনত্রিশে মার্চে লেখা ‘অসময়’ ছড়াটির বিষয়বস্তু এরকমই।

অতিথির নেই পাস
দ্যাখে তাই আশপাশ 
দেরি করা চলে না 
কথা বেশি বলে না
তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষে 
চুপিসারে বেরিয়ে সে 
ছাতাটার আড়ালে
দ্রুত পা বাড়ালে--

নিবারণ! নিবারণ!
এখন আসা বারণ!
লকডাউন
প্রতীকী ছবি

তখনো আঁচ করা যায়নি,  করোনার জন্য কতদিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। এপ্রিলের চার তারিখ লিখলাম ‘দুর্যোগ’। রোগটা যে বাইরে থেকে এসেছে, সেকথাই তখন সবার মুখে মুখে ঘুরছে।

এরোপ্লেনে উড়ে এসে 
জুড়ে বসল দেশে,
কেউ জানে না অবস্থা কী  
দাঁড়ায় অবশেষে!
ঘরের ভিতর বন্দী মানুষ 
চিন্তা-আকুল মন,
সকল দেশের সীমা ভেঙে 
কাঁপছে এ ভুবন!
লাখে লাখে হচ্ছে কাবু 
দুনিয়া জুড়ে ত্রাস, 
কেউ জানে না থামবে কবে 
করোনা সন্ত্রাস!

যেভাবেই আসুক, করোনা এসেছে দেশে। নতুন বলে, এই ভাইরাসের চরিত্র নিয়ে মানুষের জ্ঞানগম্যিও কম। কোভিড-১৯-এর কোনও ওষুধ নেই। এই রোগ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তারাও তখন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছেন। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে নানা রকম বিভ্রান্তি। এরই মধ্যে কিছু মানুষ দৈবনির্ভর হয়ে এই অসুখ থেকে বাঁচার পথ খুজছেন। তখন পাঁচই এপ্রিল লিখলাম ‘সত্যি কথা’ নামের এই ছড়াটা।

মাদুলিতে বাঁচাবে না 
করোনাতে ধরলে
জ্যোতিষী ঠকিয়ে খায়    
কেউ রোগে পড়লে।
পাষাণে ঠেকিয়ে মাথা  
নেই কিছু ফয়দা
হাওয়াতে ভরে না পেট-- 
চাই আটা ময়দা।
বিজ্ঞানই পারে রোগ 
নির্মূল করতে 
ফালতু ছুটো না কেউ
বাবা টাবা ধরতে!
mask, gloves, sanitizer; করোনা
প্রতীকী ছবি

বাবা টাবা ধরে লাভ নেই। তবে একটা ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই, অন্যের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তেরোই এপ্রিলে লেখা ছড়া ‘বুঝলে’। দেখা যাক, ‘বুঝলে’ কী বোঝাতে চায়।

বুঝলে দাদা,
আমি এখন ঘুমিয়ে কাদা।
বুঝলে দিদি,
পড়ছি আবার এবিসিডি। 
বুঝলে ভাই, 
বিগড়ে আছে মেজাজটাই। 
বুঝলে বোন,
ছাড়তে মানা ঘরের কোণ।
বুঝলে কাকা,
বন্ধ এখন হাঁকাডাকা।
বুঝলে কাকি,
নাইবা গেলে এবার টাকি।
বুঝলে মেসো,
ছ'-মাস গেলে তবেই এসো।
বুঝলে মাসি,
সবার মুখে বন্ধ হাসি।
বুঝলে বাবা,
ভাঁড়ারে ফুরোচ্ছে খাবার ।
বুঝলে মা,
বাইরে কোথাও যাচ্ছি না।

যা বোঝার তা-ই বোঝা গেল।  একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনরাত গৃহবন্দী থাকা মানুষের জীবনের ছবি ধরা পড়েছে আঠারোই এপ্রিলে লেখা ‘ভুলেই গেছি’ নামের ছড়াটায়।

ভুলেই গেছি কাঁদতে
ভুলে গেছি রোববার এলে 
ভালমন্দ রাঁধতে!

সকাল-সন্ধে বাড়ি এখন  
বিষণ্ণতায় ঢাকা 
প্রহরগুলো কাটছে সবার    
বড্ড ফাঁকা ফাঁকা! 

বইয়ের মধ্যে মন বসে না 
মন বসে না খেলায় 
মন বসে না ইউটিউবে 
নিঝুম সন্ধেবেলায়।

ফোন আসে না যখন তখন 
ফোন করি না বেশি 
ভুলেই গেছি দেখতে কেমন 
নিকট প্রতিবেশী ।

ভুলে গেছি কেমন করে 
চাঁদটাকে হয় বাঁধতে 
ভুলে গেছি হাসতে এখন 
ভুলেই গেছি কাঁদতে!
শুনশান রাস্তা; করোনা
প্রতীকী ছবি

এইভাবেই দিন কাটে। করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মনের মধ্যে দুঃসহ বোঝার মতো  করোনা চেপে বসে থাকে । কেউই বলতে পারেন না, এই মারণ ব্যাধি থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে। আঠারোই মে লিখলাম ‘করোনার পাঁচালি‘।

সবকিছু থেমে গেছে করোনার ঝড়ে,
একটাই মাথা আছে মানুষের ঘাড়ে।
দামি সেই মাথাটাকে বাঁচাবার তরে
সবাই বন্দী আছি যার যার ঘরে!

গাড়িঘোড়া চলছে না, চলছে না প্লেন,
সার বেঁধে থেমে আছে অগুনতি ট্রেন। 
আপিসে ঝুলিয়ে তালা বড়োবাবু ঘরে
দু-বেলা নিজের হাতে প্লেট সাফ করে!

ইস্কুল কলেজের থেমে গেছে ক্লাস, 
কোচিং-এর ঘরে তালা টানা দেড় মাস।
শহরের পথে পথে ময়ূরেরা চরে
পরিযায়ী শ্রমিকের পায়ে খুন ঝরে!

মরছে মানুষ কত সারা পৃথিবীতে,
অনেকের হয়তো বা ফাঁকা হল ভিটে।
করোনা পৃথিবী ছেড়ে গেলে চিরতরে,
ডাকবে খুশির বান প্রতি ঘরে ঘরে!
পরিযায়ী শ্রমিক;
প্রতীকী ছবি

খুশির বান ডাকার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। চোদ্দোই জুলাই ‘করোনার দাওয়াই’ লিখি। দাওয়াই আর কিছুই নয়; বাড়িতে থাকা, মাস্ক ব্যবহার করা আর সাবানে হাত ধোওয়া।

করোনায় ধরে যদি হয়ে যাবে হদ্দ,
এপাড়ার ওপাড়ার ছোঁড়া, ছুঁড়ি, মদ্দ!
রোগ বড়ো ভয়ানক, নেই তাতে সন্দ,
যতই বাতেলা দিক শ্রী শ্রী বাবু নন্দ!
যার যার ঘরে থেকো, হাত ধোও সাবানে,
সাবধান! মাস্ক ছাড়া রাস্তায় যাওয়া নেই!
টিকার টিকিটি আজো রয়েছে অদৃশ্য,
সাবধান! সাবধান! যত গুরুশিষ্য!
hand wash, করোনা
প্রতীকী ছবি

হলে কী হবে! কিছু মানুষের মাস্ক ব্যবহারে তীব্র অনীহা! কেউ কেউ মাস্ক ছাড়াই রাস্তায়। কারো মাস্ক হাতে কিংবা পকেটে। কারো মাস্ক থুতনিতে, কারো কপালে, কারো বা কানে ঝোলানো অবস্থায়! কী আর করা যাবে! এঁদের বলে তো লাভ হয়নি কিছুই! তাই খানিকটা আত্মকথনের ঢংয়ে পনেরোই অক্টোবর লিখি ‘কারণটা তার।’

হাসি পেলেও হাসব না
কাশি পেলেও কাশব না। 

কান্না পেলেও কাঁদব না 
ভালোমন্দ রাঁধব না।

গলা খুলে হাঁচব না
নাচ পেলেও নাচব না।

কাছে আসতে সাধব না
গল্পগাছা ফাঁদব না।

কোনো ছাদে ছাঁদব না
দু-হাত দিয়ে বাঁধব না।

না না এখন ধরো না 
কারণটা তার করোনা।

এর পরের ছড়াটার সঙ্গে করোনার সরাসরি যোগ নেই। সামাজিক মাধ্যমে একটা ভিডিওতে একটা বিশেষ নদীর জল থেকে সংগৃহীত ব্যাকটেরিয়া-খাদক ভাইরাস (Bacteriophage) নিয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে বলা হল, ‘ভারতে করোনা ভাইরাস মারার হাতিয়ার পাওয়া গেছে।’ বলা বাহুল্য, এরকম দাবির কোনও সারবত্তা নেই। এরই জেরে ষোলোই অক্টোবর লিখতে হল ব্যাকটেরিয়াভোজী ভাইরাসের আত্মকথা– ‘তাই তাই তাই’ নামের ছড়াটা।

তাই তাই তাই
তামাম দুনিয়ায় 
জলেডাঙায় সব জায়গায়
বসত করি ভাই।
তাই তাই তাই 
চিন্তা কিছু নাই 
লেজ দুলিয়ে গাপুসগুপুস 
ব্যাকটেরিয়া খাই!
তাই তাই তাই 
ব্যাপার শোনো ভাই 
ভাইরাসদের মেরে ফেলার 
ক্ষ্যামতা মোদের নাই!

জানি, বিজ্ঞানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বারেবারেই নানারকম উদ্ভট দাবি হাজির করা হবে। তখন আবার নামতে হবে যুক্তি নিয়ে, ছড়া নিয়ে, কবিতা নিয়ে।

এদিকে পুজো এসে গেল। আগে মনে হয়েছিল, এবার নমোনমো করে পুজো হবে। কিন্তু বাস্তবে ধুমধাম করেই পুজোর উদ্যোগ দেখা গেল। হাইকোর্টে মামলা হতে মহামান্য বিচারপতিরা আদেশ দিলেন, পুজো মণ্ডপে কোনও দর্শক প্রবেশ করতে পারবেন না। ছোট মণ্ডপের পাঁচ মিটার দূরে ও বড়ো প্যান্ডেলের দশ মিটার দূরে ব্যারিকেড তৈরি করে ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড লাগাতে হবে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক মানুষ পুজো দেখতে বাড়ি থেকে বেরোলেও পুজোতে খুব একটা কম ভিড় হয়নি। কেরলের ওনাম উৎসবের ভিড় থেকে ওই রাজ্যে করোনার সংক্রমণ মারাত্মক বেড়ে গেছে। কেরলের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের রাজ্যের দুর্গাপুজোর জনসমাগম দেখে রীতিমতো আশঙ্কা হচ্ছে! পুজোতে এবার কোনও কেনাকাটা করিনি। করোনার জন্য পুজোতে এবার একদিনও বেরোইনি আমরা। সতেরোই অক্টোবরে লেখা ‘আমার পুজো’ ছড়াটার জন্ম এই ভাবনা থেকেই।

আমার পুজো আমার 
নয় তা কোনো চেনা লোকের
নয় তা কোনো মামার।

এবার পুজোয় আমার 
দরকার নেই কেনাকাটার 
দরকার নেই জামার।
 
এবার পুজোয় আমি
প্রমাণ দেব পুজোর চেয়ে 
জীবন অনেক দামি!

বলার অপেক্ষা রাখে না, জীবন অনেক দামি। তবু ছড়া ও কবিতায় বলতে হয় ওরকম। কেউ শুনুক আর না শুনুক, বারবার ওই কথা বলে যাব।

2 thoughts on “জীবন অনেক দামি”

  1. অসাধারণ প্রত্যেকটা লেখা ও কবিতা, চলতে থাকুক, আপনার সবকটি লেখার পাতা ।
    অসামান্য আপনার মনের ভাব,
    করানো তে ও সে প্রকাশ পাক ।

    1. প্রেরণাদায়ী মন্তব্যের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
      ভালো থাকবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *