প্রণতি মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথই তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। রবীন্দ্রবলয়ে তাঁর সারা জীবনের  ক্লান্তিহীন বিহার। তাঁর অর্থাৎ বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পৌত্রী  প্রণতি মুখোপাধ্যায়ের। অনাথ দেব লেনের তাঁর দোতলার ঘরের  সবখানেই রবীন্দ্রনাথ। লেখালেখির প্রয়োজনে সমগ্র রবীন্দ্ররচনাবলীর একাধিক সংস্করণের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বই ও পত্রপত্রিকার বিশাল সংগ্রহ। সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথের লেখা, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত লেখা, রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বলয়ের বিদ্বান ও গুণী মানুষদের লেখা বইপত্র পড়েন আর লেখেন। এটাই তাঁর রোজকার রুটিন। এর বাইরে আর সবকিছুই তাঁর কাছে সেকেন্ডারি।

সবকিছুই তিনি করেন খুব যত্ন করে। কোনও কিছুতেই তাঁর তাড়াহুড়ো নেই। ধীরে ধীরে লেখেন। মুক্তোর মতো তাঁর হাতের লেখা। সাদা কাগজের বাঁদিকে সামান্য মার্জিন ছেড়ে লেখেন– মার্জিন কোথাও এতটুকু কম বা বেশি হয় না। লাইন কোথাও একটুও বাঁকে না। অনুচ্চস্বরে ধীর গতিতে কথা বলেন। বড়ো মিষ্টি সেই কথার ধরন। শব্দচয়নে অসম্ভব যত্নশীল। তাঁর ব্যবহৃত কোনও শব্দই কর্কশ  নয়। বাংলা বলার সময় খুব প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না। তাঁর বাড়ি গেলে, তাঁর কথা শুনলে, মনে হয় সে এক অন্য ভুবন– যেখানে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ মালিন্যের প্রবেশ নিষেধ।

১৯৯২ সালের গোড়ার দিকে, বাংলা আকাদেমি থেকে প্রণতি মুখোপাধ্যায়কে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা বই লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আকাদেমির এই ধরনের বইগুলো কমবেশি একশো পাতার মধ্যে হয়। অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা চালিয়ে তিনি লেখার যে পরিকল্পনা করলেন, তা আকাদেমির প্রকল্প থেকে একেবারেই আলাদা। তৎকালীন বাংলা আকাদেমি কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে সব শুনে তাঁর পরিকল্পনা মতোই আচার্য  ক্ষিতিমোহন সেনের জীবনী লেখার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। ফলে আমরা পেলাম আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের এক অসামান্য জীবনী — ‘ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন।’ তথ্যবহুল ও অত্যন্ত সুলিখিত এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। মুখবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, ‘ক্ষিতিমোহন সেনের জীবনী লেখা সহজ কাজ নয়। একদিকে তিনি অধ্যাপক, অন্যদিকে পর্যটক। একদিকে প্রাচীন পুথিতে পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে পুথিবিহীন কাব্য ও  সংগীত সংগ্রহে অদম্য উদ্যম।একদিকে শুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় নিমগ্নতা, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিরোধ প্রমুখ নানা বাস্তব সমস্যার সমাধান-প্রচেষ্টায় যুক্তি অনুসন্ধান। একদিকে বিদ্যাচর্চায় পূর্ণ আত্মনিয়োগ, অন্যদিকে পারিবারিক মঙ্গল-প্রচেষ্টায় বিরামহীন শ্রমসহিষ্ণুতা। এ কাজটি হাতে নিতে যে শ্রীমতী প্রণতি মুখোপাধ্যায় সাহস পেয়েছেন, তাতে তাঁর সুচিন্তিত আগ্রহের, সাধনার এবং যুক্তিযুক্ত আত্মবিশ্বাসের পরিচয় আছে। এবং এ কাজটি যে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি শেষ করেছেন, তাতে তাঁর আশ্চর্য কর্মক্ষমতা ও অসামান্য কর্মপন্থার প্রমাণ পাওয়া যায়।’ এই বইয়ে তিনি এমন অনেক নথি ব্যবহার করেছেন যা এর আগে অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৯ সালে এই বই প্রকাশিত হয়। নিবেদন, মুখবন্ধ, ভূমিকা ও সূচিপত্র বাদ দিয়ে এই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৮৭ (দ্বিতীয় মুদ্রণ)। এই বইয়ের জন্য তিনি ২০০২ সালে রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার পান।

প্রণতি মুখপাধ্যায়ের একটি বইয়ের প্রচ্ছদ।
ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন

তাঁর জীবনভর সাধনার পরিচয় ছড়িয়ে আছে যে সব গ্রন্থে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’, ‘রবীন্দ্র সংস্পর্শে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও রমা কর’, ‘কবি এক জাগে’ (গীতাঞ্জলি ও তার ইংরেজি অনুবাদ), ‘উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ারসন’, ‘রবীন্দ্র-কক্ষপথে ক্ষিতিমোহন সেন’, ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ: কালানুক্রমিক সূচি’। তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’, ‘ক্ষিতিমোহন সেনের প্রবন্ধ: সাধক ও সাধনা’, ‘ভারত পরিক্রমা’, ‘বঙ্গমানস ও অন্যান্য’।

অনেকদিন আগে প্রণতিদি একদিন বলেছিলেন, ‘শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক দিলীপকুমার বিশ্বাস বয়সের কারণে এখন নিজের হাতে আর লিখতে পারেন না। একটা ছেলে বা মেয়ে জোগাড় করে দাও, যে ওনার ইংরেজি ও বাংলা ডিকটেশন শুনে ঠিকঠাক লিখে রাখতে পারবে। তার জন্য তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।’ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দিলীপকুমার বিশ্বাস একজন বিশিষ্ট রামমোহন বিশেষজ্ঞ। ওনার ‘রামমোহন-সমীক্ষা’ রাজা রামমোহন রায়ের ওপর একটা প্রামাণ্য বই। ওনার সম্পাদনায় ‘The Correspondence of Raja Ram Mohan Roy’-এর দুটি খণ্ড দেশেবিদেশের বিদগ্ধ মহলে খুবই সমাদৃত। দুঃখের বিষয়, অনেক চেষ্টা করেও ওনার ডিকটেশন নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কোনও ছেলে বা মেয়ে জোগাড় করতে পারিনি। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল তাদের কেউ কেউ বলেছিল, ‘বাংলা ঠিক আছে, কিন্তু  ইংরেজি ডিকটেশন নিতে পারব না।’ আবার কেউবা এমন কথাও বলেছিল, ‘ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছি, ইংলিশ ও.কে., কিন্তু বাংলা ডিকটেশন নিতে পারব না।’ তথাকথিত সাম্মানিক স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের এহেন কথা শুনে প্রণতিদি যারপরনাই দুঃখ পেয়েছিলেন।

তাঁর অন্তরে রবীন্দ্রনাথ, বাইরে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রময় প্রণতিদি এক ব্যতিক্রমী মানবী!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *