প্রকৃতির ভুল

রঙ্গলাল দত্ত তখন খ্যাতির মধ্য গগনে। মহকুমা শহর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় মাঝেমাঝে প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর মতামত ও মন্তব্য ছাপা হত। এই কারণে তাঁর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই শহর থেকে অনেক দূরের এক গ্রামে থেকেও আমরা তাঁর নাম জানতে পেরেছিলাম। তাঁর ছাত্রদের মতো অন্যরাও তাঁকে আরএলডি স্যার বলে ডাকতেন।

আরএলডি স্যার ছিলেন একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রকৃতি বিজ্ঞানের শিক্ষক। লোকমুখে শুনেছিলাম, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডালিস্ট।

শহরে কলেজে পড়তে আসার আগে ওনাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। তবে কলেজে পড়তে আসার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক দূর থেকে ওনাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আরএলডি স্যার তখন হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলেন। ওই ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, “উনি গ্রিক ভাষায় খুব দক্ষ।” বলা বাহুল্য, ওনার গ্রিক ভাষা জানার সংবাদে ওনার প্রতি আমার আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

ঘটনাচক্রে, আরএলডি স্যারকে চাক্ষুষ করার পরের মাসেই আমার ওনার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ আসে। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে, শহরের কয়েকজন বিজ্ঞানজিজ্ঞাসু মানুষের উদ্যোগে বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে একমাত্র বক্তা ছিলেন আরএলডি স্যার। আয়োজকেরা আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওনাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসার। আমি সানন্দে সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য একটু আগে ভাগেই ওনার বাড়ি গিয়ে হাজির হই।

আরএলডি স্যার শহরের প্রাণকেন্দ্রে কাঁঠালগাছে ঘেরা একটা একতলা বাড়িতে থাকতেন। দরজায় কড়া নাড়াতে উনি নিজেই দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢোকার পরে আমাকে বসতে বলেননি বলে প্রণাম করে আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম। উনি চেয়ারে বসে কিছু লিখেছিলেন। পরনে ধুতি ও নীলরঙের শার্ট। বহু কষ্টে বোঝা যায় পরনের ধুতিটা এক সময় সাদা ছিল। মাথায় উসকোখুসকো না আঁচড়ানো চুল। ফুল শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। হাতের অনাবৃত অংশে খড়ি পড়ার দাগ।

দেখে মনে হল, বহুদিন উনি চান করেননি। ওনার ওই ময়লা জামাকাপড় পরা অবিন্যস্ত চেহারা দেখে কেন জানি না আমার  সক্রেটিসের কথা মনে পড়ে গেল। (হতে পারে, ওনার গ্রিক ভাষায় পারঙ্গমতার কারণে সক্রেটিসের কথা মনে এসেছিল)। মনে মনে ভাবলাম, দিনরাত পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত-থাকা মানুষ– চান করার সময় পান না।

লিখতে লিখতে হঠাৎ তাঁর নজর গেল আমার ডানহাতে থাকা ছাতার দিকে। উনি চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “ছাতা, ছাতা কী হবে?”

আমি মিনমিন করে বললাম, “স্যার, এখন তো বর্ষাকাল, বৃষ্টি হতে পারে। তাই…..”

 হঠাৎ উনি ডানহাত মুঠো করে আমার মাথায় জোরসে একটা গাঁট্টা মেরে বললেন, “এইটা, এইটা আছে কী জন্য? বর্ষাকাল হলেই বৃষ্টি হবে এমন কথা কোথায় লেখা আছে?”

আমি তখন যাকে বলে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ! সামান্য চুপ করে থেকে আমার মাথায় আর একটা গাঁট্টা (এবার একটু কম ওজনের) মেরে বললেন, “মস্তিষ্কচর্চা করবে না? আকাশ পর্যবেক্ষণ করবে না? বর্ষাকাল হলেই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়!”

আমি যথারীতি চুপ করে থাকি।

এর পর উনি ঘর থেকে বেরোলেন আকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। আমি ওনাকে অনুসরণ করলাম। মিনিট পাঁচেক আকাশ পর্যবেক্ষণ ও মস্তিষ্কচর্চা করে উনি রায় দিলেন, “আগামী সাতদিন এখানে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হবে না।” রায় ঘোষণা করে আমার ছাতার দিকে দৃষ্টিপাত করে আর এক দফা আমাকে ভর্ৎসনা করলেন।

বলা বাহুল্য, মন্ত্রমুগ্ধ আমার মুখে তখন কোনও কথাই  বেরোচ্ছিল না।

এরপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে উনি বেরোলেন। যে ধুতি ও শার্ট পরে বাড়িতে ছিলেন, সেই পোশাকেই বেরোলেন। কাঁধে একটা পুরনো ময়লা সাইডব্যাগ। ওই ব্যাগের মধ্যে ওনার লেকচারারের কাগজপত্র।

সভাস্থল বেশি দূরে নয়। তাই আমরা হেঁটেই যাচ্ছিলাম। তিন-চার মিনিট পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল! শশব্যস্ত হয়ে আমি ওনার মাথায় ছাতা ধরতে যেতেই উনি ডানহাতের কনুই দিয়ে আমার পাঁজরে একটা জোর গুঁতো মারলেন। গুঁতো মেরে বললেন,  “আগামী সাতদিন এখানে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হবে না।”

ওনার গুঁতো খেয়ে আমার তখন অবস্থা কাহিল! অনেক কষ্টে বললাম, “স্যার, বৃষ্টি হচ্ছে তো!”

উনি বললেন, “না, আগামী সাতদিন এখানে বৃষ্টি হতে পারে না।”

মাথায় গুঁতো খেয়ে বোধ হয়, আমি আমার গ্রামীণ সত্তায় ফিরে গিয়েছিলাম। মনে হল, প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে যখন, তখন আগামী সাতদিন বৃষ্টি না হওয়ার ঘোষণার মধ্যে বিজ্ঞান-টিজ্ঞান কিছু নেই। ওটা স্রেফ একটা ভ্রান্তি।

তাই গলায় একটু জোর এনে বললাম, “স্যার, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, আর আপনি বলছেন, বৃষ্টি হচ্ছে না!”

এবার আমার কথায় উনি সামান্য হলেও একটু গুরুত্ব দিলেন। বললেন, “হ্যাঁ, প্রকৃতির নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে।”

একথার উত্তরে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। আমিও চুপ করে থাকি।

আমি আর একবার ওনার মাথায় ছাতা ধরতে গেলাম। এবারও উনি কনুই বাগিয়ে গুঁতো মারতে সচেষ্ট হলেন। এবার অবশ্য কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে তাঁর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচালাম।

ভিজতে ভিজতে দুজনে যখন সভাস্থলে পৌঁছালাম তখন আবার আমার ছাতা নিয়ে টানাটানি শুরু হল। সভার উদ্যোক্তরা রাগতভাবে বললেন, ” আরএলডি স্যারকে যদি ভিজতেই হয়, তাহলে ছাতাটা সঙ্গে রেখেছ কেন?” স্যারের মাথায় ছাতা ধরার আমার ব্যর্থ প্রচেষ্টার কাহিনি আনুপূর্বিক শোনার পরেও উদ্যোক্তারা বললেন, “যাই বলো, কাজটা তুমি ঠিক করনি। তোমার কাছে ছাতা থাকতে স্যারকে ভিজতে দেওয়া তোমার ঠিক হয়নি।”

 উদ্যোক্তাদের একথার আর উত্তর দিই না। মুখে কুলুপ এঁটে থাকি।

এদিকে বৃষ্টির জন্য সভায় লোকজন প্রায় না আসার মতো। স্যারের লেকচারারের কাগজপত্রও  ভিজে গেছে। তাই একটু বাদে আয়োজকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওই দিনের আলোচনা সভা বাতিল করে দিলেন। মাইকে ঘোষণা করলেন, পরের মাসে কোনো একদিন ওই সভার আয়োজন করা হবে। তারিখ পরে জানানো হবে।

পরের মাসের সভার কথা অবশ্য আমি আর জানতে পারিনি। তাই আরএলডি স্যারের বক্তৃতাও আমার শোনা হয়নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *